রোদ কমে আসছিল। সাথে সাথে আমাদের এনার্জিও। আগ্রা ফোর্টের ভিতরে পাথরের আড়ালে বেশ ছায়া। ঢোকার মুখে বেশ চওড়া আর বিশাল উঁচু এক করিডোরের মত। যেখান থেকে হাততালি দিয়ে আগন্তুকের আগমন বার্তা পাঠানো হত কেল্লার ভিতরে। আশ্চর্য্য 'কথা' প্রতিফলিত হয়না কিন্তু 'আওয়াজ' প্রতিফলিত হয়। জায়গাটা ঢালু তাই দোতলার সমান উচ্চতা উঠে এলাম কোনও কষ্ট না করেই। পরপর মহল গুলো পার হচ্ছি আর চোখের সামনে যেন ইতিহাসের একএকটা অধ্যায় খুলে যাচ্ছে। সম্রাটদের পছন্দের নির্মানই তাদের পরিচয়। আকবর পছন্দ করতেন লাল বালু পাথর, জাহাঙ্গীর পছন্দ করতেন সাদা কিন্তু মার্বেল হয়তো সহজলভ্য ছিলনা সেই সময়। তাই বেলে পাথরের ওপর চুনের পলেস্তারা। আর শাহজাহানের মহল, সে এক অপূর্ব সৃষ্টি। সাদা মার্বেলের ওপর দামী রঙীন পাথরের নকশা। দেওয়ানি আম, দেওয়ানি খাস - সে এক অসাধারণ সৃষ্টি। আমরা এসে দাঁড়ালাম সেই মহলের সামনে যেখানে শাহজাহান শেষ ক'বছর বন্দী ছিলেন। পরন্ত বিকেলের আলোয় মহল টাকে আরও বেশী বিষন্ন লাগছিল। দেওয়ানি খাসের সামনের বিশাল প্রাঙ্গণ থেকে দেখা যাচ্ছিল তাজমহলকে। মনেহচ্ছিল তাজমহলও তার একাকীত্ব, বিষন্নতা ছড়িয়ে দিচ্ছে গোটা আগ্রা শহরে। এখান থেকেই দেখা যাচ্ছিল সেই বিখ্যাত ছাতার মত ছাদওয়ালা অলিন্দ, যেখান থেকে সম্রাট চেয়ে থাকতেন তাজমহলের দিকে। এতখানি ঘুরে আমার মা সামান্য অসুস্থ বোধ করছিলেন। একটা জায়গা দেখে উনি একটু বসলেন।আর আমরা চারপাশে চোখ ঘোরালাম। ঝাঁকেঝাঁকে টিয়াপাখি এসে কলরব করছে, এ এক বিরাট লোভনিয় দৃশ্য আমাদের কাছে। ইট কাঠ পাথরের জঙ্গলে এই দৃশ্য অমূল্য।আমাদের ঠিক নীচে একতলায় সার দিয়ে অসংখ্য কামরা। যারা দেখছিলেন বলতে শুরু করলেন ওগুলো দোকান। কিন্তু ওই পুরো এলাকা ছিল আকবরের হারেম। ওপরের ঘরে থাকতেন রানীরা আর নীচের ছোট একরকম ওই কোয়াটারস্ এ থাকতো সব দাস-দাসি।দোতলায় যেখানে আমরা দাঁড়িয়েছিলাম তার পাশেই ছিল সম্রাটের বসার আসন, যেখানে বসে উনি হারেমের অভাব-অভিযোগ শুনতেন ও বিচার করতেন। ওখান থেকে আমরা সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম দেওয়ানি আম। সম্রাট যেখানে বসতেন সে জায়গাটি খুব সুন্দর। উপরে রানীদের বসার জন্য আড়াল বজায় রেখে জায়গা রয়েছে। আমরা সকলেই জানি আকবরের সময়কাল থেকেই রাজমহিষীরা শাসনকাজে এক বিশেষ জায়গা আলোকিত করে এসেছেন। দেওয়ানি আমের সামনেই রয়েছে বাবরের আমলে তৈরী বিশাল 'বাওলী'। বাওলী আর কুয়োঁর মধ্যে পার্থক্যটা এখানে বলে রাখি। বাওলীতে সিঁড়ি থাকে, কুয়োয় থাকেনা। আমরা এখান থেকেই সবার পিছুপিছু বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। বেরিয়েই যাচ্ছিলাম, কিন্তু থমকে দাঁড়ালাম সামনে একটা ইংরেজ সমাধি দেখে। নাম লেখা john russel colvin।হ্যাঁ মনে পড়লো পরেছিলাম উনি মোগলদের পতনের পর আগ্রা ফোর্টের চার্জে ছিলেন। কলেরা হয়ে মারা যান। ওনার দেহ বাইরে আনা যায়নি বলে ভিতরেই সমাধিস্ত করার পরিকল্পনা করা এবং সে স্থানটি ঠিক হয় একদম দেওয়ানি আমের সামনে। এ নিয়ে অনেকের আপত্তি থাকলেও শোনা হয়নি। সত্যি বড্ড বেমানান এই সমাধিটি এখানে। আর একটা কথার উল্লেখ করাটা একান্ত জরুরি। গজনীর সুলতান মামুদ যে সোমনাথ মন্দির আক্রমণ করে লুঠ করেছিলেন তা আমরা সকলেই জানি। তার সমাধি মন্দিরের দরজা ছিল হুবহু সোমনাথ মন্দিরের চন্দন কাঠের দরজার ন্যয়। অনুমান করা হয়ওটি সোমনাথ মন্দিরেরই দরজা। ইংরেজরা সেটি উখরে তুলে নিয়ে আসে আর আগ্রা ফোর্টে সেটি রাখে। কিন্তু পরে জানা যায় ওটি স্থানীয় কারিগর দিয়ে তৈরী একটি দরজা। সে দরজা আজও বিদ্যমান ফোর্টে।
বিকেল ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে সন্ধ্যের দিকে। আমরাও ইতিহাসকে 'কাল'এর হাতে ছেড়ে বেড়িয়ে এলাম।