Friday, 28 September 2018

পুরস্কার

সৌরভ  একজন সুদর্শন ও উচ্চশিক্ষিত যুবক। কিন্তু  চাকরির পরীক্ষায় সে কখনই উত্তীর্ণ হতে পারেনি। যতবারই পরীক্ষা দিতে বসেছে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে, পারবো কি পারবো না,  এই শঙ্কায় জানা জিনিসও সব ভুল করে এসেছে। তাই তার ভালো চাকরি করা আর হলো না। অবশেষে বাবার পরিচিত এক জুতোর দোকানের মালিকের কাছে জুতো বিক্রি করতে ঢুকে গেলো। তার কলেজের সহপাঠী এবং সহপাঠিনীরা জুতো কিনতে আসে তাকে দিয়ে জুতো পায় গলিয়ে চেষ্টা করে আর মুখ টিপে হাসে। সৌরভ  ভয়ে কারো মুখের দিকে তাকাতে পারে পাছে তাকে নিয়ে মশকরা করা সে নিজের চোখে দেখে ফেলে। রোজ সে আসে ঘাড় গোঁজ করে কাজ করে।

এরমধ্যে একদিন মদনদা চেঁচিয়ে বল্ল, "এই সৌরভ 'লেডি ডায়না' টা পাঁচ নম্বরটা  দিদিভাই কে দেখা তো" রোজকার মতো আজও সৌরভ মাথা নীচু করে জুতো পায়ে মাপমত আছে কিনা দেখে সঠিক মাপের জুতো  কাউন্টারএ পাঠিয়ে দিল। মেয়েটি অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিলো ফোনে। তাকিয়ে একবার দেখলোও না জুতোটা কেমন লাগছে। কিন্তু সৌরভ মেয়েটির পা দুটি দেখেছে। এমন সুন্দর পা বোধহয় সিন্ডারেলাই ছিলো। সাহস করে সে আর পা এর মালকিনের মুখের দিকে তাকাতে পারেনি।কারন সে তার যোগ্যতা নিয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিল।

মেয়েটি দোকান থেকে বেরিয়ে যাবার পর হঠাৎই সৌরভ আবিষ্কার করলো যে মেয়েটি তার ছোট্ট পার্সটা ফেলে গেছে। সে পার্সটা খুলে দেখলো ভিতরে একটা কম্প্যাক্ট পাউডার আর একটা মনে হয় হিরের হাতের গহনা রয়েছে। সৌরভ কী করবে ভেবেই পেলনা। দোকানের মালিকটা ভিষন চামার ব্যাগ ওর কাছে জমা দিলে কিচ্ছু থাকবেনা। যদি মেয়েটি ফিরে আসে! সে ব্যাগটা নিয়ে নিজের ঝোলাতে রেখে দিলো।

এরপর বহুদিন হয়েগেছে। দিন ছেড়ে সপ্তাহ,  সপ্তাহ ছেড়ে মাস,  মাস ছেড়ে বছর হতে চল্ল।মেয়েটি আর আসেনি কিন্তু সৌরভ ওই ব্যাগ কাছ ছাড়া করে নি। পুজো এসে গেছে দোকানে প্রচুর ভীড়। হঠাৎই একটা পরিচিত কন্ঠস্বর শুনতে পেলো সৌরভ। চারিদিকে দেখার চেষ্টা করতে লাগলো। তার কোনো ভুল হয়নি এ সেই মেয়েটিরই গলা। কিন্তু কি করে চিনবে সে! মুখ তো দেখেনি। একটু পরেই হাঁক এলো, "সৌরভ  দিদিভাই কে ব্যালেরিনা পাঁচ নম্বরট দেখা তো।" সৌরভ  জুতোটা পায়ে ঢুকাতে গিয়ে দেখলো, হ্যা এই পা সে চেনে দশ মাস আগে এই পায়েই জুতো পরিয়ে ছিলো সে। সে চট করে মুখের দিকে তাকালো। খুব সুন্দরী একজন কমবয়সি মহিলা। মহিলা কে অবাক করে সৌরভ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো, "ম্যাডাম আপনি দু মিনিট  বসুন আমি এক্ষুনি আসছি" কথা শেষ হতে না হতেই সে এক ছুটে ভিতরে গিয়ে ঝোলা থেকে পার্সটা বার করে মহিলার সামনে এসে দাঁড়াল, এগিয়ে দিলো মহিলার দিকে। মহিলা উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছেন ব্যাগ দেখে। ব্যাগ খুলে উনি দ্রুত দেখে নিলেন ওনার মহামুল্যবান গহনাটি। "তুমি এটা কোথায় পেলে!!" উনি বিস্ময়ে হতবাক
"আপনি গতবার এখানেই ফেলে গিয়েছিলেন।" সৌরভ কুন্ঠিত হয়ে বল্ল।সারা দোকানে তখন পিন পরলেও শোনা যাবে। এর মধ্যে মহিলার স্বামীও ঢুকেছেন দোকানে। মহিলা বললেন, "তুমি জানতে এর মধ্যে কি আছে"
"হ্যা ম্যাম"
মহিলা এবং ভদ্রলোক দুজনেই অবাক।
"তাহলে এটা এতদিন এইভাবে রেখে দিয়েছো কেন, বিক্রি কেন করনি"
সৌরভ দীপ্ত কন্ঠে বলে, "মা বলেন গহনা নারীর সন্মান তাকে বিক্রি করা যায়না" ওনারা স্বামী স্ত্রী  মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। এইসম্য মালিক কাউন্টার ছেড়ে উঠে এলো। হাত কচলাতে কচলাতে বল্ল, "ও খুব শিক্ষিত কিন্তু চাকরি পায়নি। খুব গরীব ওরা"
 ভদ্রলোক পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করতে করতে বললেন," সততার যে কোনও  সারর্টিফিকেট হয়না, তাই ও চাকরি পায়নি" উনি একটা ভিসিটিং কার্ড এগিয়ে দিয়ে সৌরভ কে বল্লেন, "কাল অফিসে এসো"








Thursday, 27 September 2018

দিল্লী-আগ্রা একাদশ পর্ব


দিল্লীর শাষনব্যবস্থার টলোমলোতার সুযোগে মারাঠারা 1752 সালে দিল্লীর ক্ষমতা কবজা করে সাথে সাথে ফতেহ্পুর সিক্রী ওদের দখলে চলে আসে। 1803 সালে দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে দিললী আসতেই ফতেহপুর সিক্রীও ইংরেজদের অধিন হয়ে যায় আল তারাযথেচ্ছভাবে রাজমহল ও অন্যান্য বাসভবনগুলিকে ব্যবহার করে এবং ব্যারাক বানিয়ে নষ্ট করে ফেলে। কিন্তু লর্ড কার্জন যখন ক্ষমতা হাতে পান, নষ্ট হওয়া ইতিহাস পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন। এখন যে টুকু আমরা দেখতে পাই তা লর্ড কার্জনেরই জন্য।
আর একটি স্থাপত্যের ইতিহাস জেনে আমার খুব খারাপ লেগেছিল। সেটি হল সম্রাট আকবরের সমাধি। আমি আগের বার গিয়েছিলাম, এবার যাবার সময় হয়নি। আকবরের সমাধি দেখে মনে হয়েছিল এতবড় একজন সম্রাটের সমাধি এত সাধারন সাজসজ্জা কি করে হয়!!.......আকবরের সমাধি তৈরী হতে সময় লেগেছিল 1605 - 1613 সাল। আকবর তার জীবদ্দশায় স্থান ঠিক করে গিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর জাহাঙ্গীর তৈরী করেন। তিনি দামি পাথর হিরে জহরত দিয়ে অপূর্ব করে এর সাজসজ্জা করেন। মাটিতে পাতেন দামী পার্শিয়ান কার্পেট। এক কথায় অসাধারন ছিল সে সমাধি মন্দির।
আকবরের প্রপৌত্র ঔরঙ্গজেবের সময় জাঠদের উত্থান হয় রাজা রাম জাঠের নেতৃত্বে।পরবর্তিকালে জাঠরা আগ্রা ফোর্ট জয় করে নেয় মোগলদের হারিয়ে। সেই সময় তারা আকবরের সমাধি থেকে সোনা দামী হিরে জহরত সব খুবলে তুলে লুঠ করে। এবং সব থেকে অমানবিক কাজ যা তারা করেছিল তি হল , রাম জাঠের বাবা গোকুলের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে আকবরেল সমাধি থেকে আকবরের কঙ্কাল তুলে পুড়িয়ে দেয়।...... তাই আকবরের যে সমাধি আমরা দেখি সেখানে আকবরের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।
পরের পর্বে দিল্লীর লালকেল্লা সম্বন্ধে জানাবো।

দিল্লী-আগ্রা চতুর্থদিন দশম পর্ব


যদিও মোগোল বংশ এক বিশাল বংশ। তাদের সবাইকে কি আমরা জানি? আমরা শুধু ঔরঙ্গজেব পর্য্যন্ত জেনে এসেছি। আর দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ জাফরকে জানি কারণ তিনি ছিলেন শেষ মোগল সম্রাট। এদের সকলের মধ্যে আমরা মনে রেখেছি শুধু দুজনকে আকবর আর শাহ্জাহান। আকবরের সৃষ্টি ফতেহ্পুর সিক্রী আমরা দেখেছি। আমরা শাহ্জাহানের সৃষ্টি তাজমহলও দেখেছি। অনেকেই জানেন না যে দিল্লী লাল কেল্লা শাহ্জাহানেরই সৃষ্টি। সে যাই হোক প্রথমে আসি আগ্রা ফোর্টের কথায়।
আগ্রা ফোর্ট 380,000 স্কোয়ারমিটার অর্দ্ধ গোলাকৃতি একটি 4গেট যুক্ত ফোর্ট। খিজরি গেটটি যমুনার দিকে খোলে। দূর্গের পশ্চিম দিকে গেট যেটি শহর মুখী সেটি দিল্লী গেট। এটি 1568 সালে তৈরী হয় নিরাপত্তা ও সম্রাটের নিজস্ব প্রবেশ দ্বার হিসেবে।এই গেটটি পরবতী কালে শ্বেত পাথর দিয়ে নতুন করে অলঙ্কৃত হয়। এই গেটের ভিতরের দিকে দুটি প্রমাণ সাইজের পাথরের হাতি রাখা হয়েছিল তাই একে 'হাথিপোল'ও বলা হত। আর একটি গেট ছিল লাহোর গেট যেটি পরবর্তীকালে অমর সিং গেট বলে খ্যাত হয় এবং সেটিই জনগনের প্রবেশ দ্বার। দিল্লীগেট এখন ইন্ডিয়ান আর্মির অধিন।সাধারনের প্রবেশ নিষেধ।
1526-এ প্রথম পানিপথের যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদিকে হারিয়ে বাবর এই দূর্গে বাস করতে শুরু করেন।পানীয় জলের জন্য তিনি একটি বাওলি তৈরী করেন। যার উপস্থিতি এখনও আছে দেওয়ানি আম-এর সামনে।তারপর বিভিন্ন সময় মালিকানা বদল হয়েছে।আকবরের সময় থেকে এটি বংশ পরম্পরায় মোগলদের হয়। আবুল ফজল তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছিলেন যে এই দূর্গ পূর্বে বাদলগড় নামে পরিচিত একটি ইটের তৈরী দূর্গ ছিল। আকবর যখন আগ্রাকে রাজধানী হিসাবে ঘোষণা করেন তখন এটি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। রাজস্থানের বারাউলি থেকে লাল বেলে পাথর নিয়ে এসে নতুন করে এটি তৈরী শুরু হয়। 1573 সালে নতুন দুর্গটি সম্পূর্ণ হয়। আমরা এখন অবস্থায় দেখি তার প্রায় বেশিরভাগ শাহ্জাহানের সময়েই হয়। তিনি নিজের মহল তৈরীর জন্য আকবরের সময়কার বেশকিছু স্থাপত্য ভেঙ্গে ফেলেন। ঔরঙ্গজেব রাজধানি দিল্লীতে স্থানান্তরিত করার ফলে এই দূর্গে আর বাস করেন নি। পরবর্তী মোগল শাসকরা দিল্লী লাল কেল্লাতেই থাকতেন। এরপর এটি মারাঠাদের দখলে চলে যায়। আর তারপর ইংরেজ দের দখলে।
গেট দিয়ে ঢুকেই প্রথমে বেঙ্গলী মহল। যেটি পরে আকবরি মহল ও জাহাঙ্গিরি মহলে বিভক্ত হয়ে যায়।জাহাঙ্গির তাঁর বইতে এই মহলের উল্লেখ করেন। কিন্তু এই ব্যাপারে তিনি তার পিতাকেই প্রসংসিত করেছেন। পরবর্তীকালে নুরজাহান এই প্রাসাদে তার মৃত্যু পর্য্যন্ত বাস করে গিয়েছিলেন। তাই এখন এটি নুর জাহান মহল নামেই পরিচিত।
আকবরের পছন্দের স্থান কিন্তু আগ্রা ছিল না, ছিল ফতেহ্পুর সিক্রী।ফতেহ্ কথাটা শুনেই বোঝা যায় যে এখানে জয়ের কোনও ইতিহাস আছে। ঠিক তাই, চিতোর এবং রনোথম্বর জয়ের পর আকবর 1569-এ একটী নতুন জায়গায় রাজধানি সরিয়ে নিয়ে যেতে চান। সে হল আগ্রা থেকে 37 কি.মি দূরে বর্তমানের ফতেহ্পুর সিক্রী। তখন এর নাম ছিল ফতেহ্ বাদ। এই জায়গা শুধু আকবরের নয় তার পিতামহ বাবরেরও পছন্দের ছিল। এই পরকল্পিত শহরের বাইরে বাবর একটি বাগান তৈরী করেছিলেন রানা সঙ্গকে পরাস্ত করার পর। 1585তে অপর্যাপ্ত জল এবং আরও নানা কারণে আকবর তার রাজধানী লাহোরে স্থানান্তরিত করেন। কিন্তু 1601-এ আবার তিনি ফিরে আসেন এখানে।তাঁর মৃত্যুবধি তিনি এখানেই রাজধানী রেখেছিলেন। এরপর জাহাঙ্গীর এবং শাহ্জাহান আগ্রাতেই রাজধানী বহাল রেখেছিলেন আর ঔরঙ্গজেব দিল্লীতে।ইতিহাসে তখন ফতেহ্পুর সিক্রীর কথা জানা যায়নি। এরপর আবার ফতেহ্পুর সিক্রীর উল্লেখ পাওয়া যায় অন্যতম সৈয়দ ভাইয়ের খুন হওয়া থেকে। প্রশ্ন আসে কে এই সৈয়দ ভাই? সৈয়দ ভাইরা ছিলেন দুই ভাই সৈয়দ হাসান আলি খান ও সৈয়দ হুসেন আলি খান। বলা যেতে পারে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মোগল রাজনিতীর ভাগডোর এই দুই ভাইয়ের হাতেই চলে যায়। এই দুই ভাই ছিল ঔরঙ্গজেবের আইনসভার খুব গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকার। 1710-এ ঔরঙ্গজের মারা যাবার পর প্রথম বাহাদুর শাহ্ তার ভাইদের পরাস্ত করে সিংহাসন অধিকার করে সৈয়দ ভাইদের সাহায্যে।1712-তে বাহাদুর শাহ্ মারা গেলে তার উত্তরাধিকার জাহানদার শাহ্ কে সৈয়দ ভাইদের নির্দেশে হত্যা করে জাহানদারের ভাগ্নে ফারুকশিয়ারকে 1713-তে সিংহাসনে বসায়। ফারুকশিয়ার সৈয়দ ভাইদের তুষ্ট করতে না পারায় তাকে অন্ধ করে হত্যা করে এবং ফারুকশিয়ারের বড় খুরতুতো ভাই রফি উদ দারাজাতকে 1719-এর ফেব্রুয়রিতে সিংহাসনে বসায় দুই ভাই।দারাজাত ঐ বছর জুন মাসে ফুসফুসের রোগে মারা গেলে তার ভাই রফিউদদৌল্লা(দ্বিতীয় শাহ্জাহান )কে বসানো হয়, সেও ঐ একই রোগে সেই বছর সেপ্টেম্বরে মারা যায়।তখন তার 17 বছরের ছেলে মহম্মদ শাহ্কে সৈয়দ ভাইরা সিংহাসনে বসায়। 1720-তে মহম্মদ শাহ্ হুসেন আলিকে ফতেহ্পুর সিক্রীতে খুন করে এবং হাসান আলিকে বিষ প্রয়োগ করে মারা হয়। এখান থেকে আবার ফতেহপুর সিক্রীর উল্লেখ পাওয়া যায়। বাকি আবার পরের পর্বে জানাব।

দিল্লী-আগ্রা চতুর্থদিন 12/10/17 নবম পর্ব


আকবরের প্রথমা স্ত্রী রুকাইয়া বেগম ছিলেন নিঃসন্তান।পরবর্তীকালে জাহাঙ্গীরের পুত্র খুরম অর্থ্যাৎ শাহ্জাহানকে দত্তক নিয়ে নিজের মত করে মানুষ করেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্ত্রীর উল্লেখ অপ্রয়োজনীয়।চতুর্থ স্ত্রী ছিলেন সলিমা সুলতান বেগম। যিনি ছিলেন বৈরাম খানের স্ত্রী।কিন্তু আকবর চিরকাল এঁনাকে নিজের নয় বৈরাম খানের স্ত্রী হিসেবেই সন্মান করে এসেছেন। পঞ্চম স্ত্রী ছিলেন আমের রাজ বিহারিমল বা ভারমলের কন্যা যোধাবাঈ বা হরকা বাঈ। যিনি আকবরের প্রথম পুত্র সন্তান সেলিমের মা ছিলেন। যেহেতু তিনি পুত্র সন্তান উপহার দিয়েছিলেন তাই আকবর তাকে মরিয়ম-উজ-জমানি নামে ভুষিত করেন। এবং এই নামই সর্বত্র উল্লেখ আছে। আবুল ফজল একজায়গায় লিখেছেন যে আকবর ছিলেন তার পূর্বপুরুষের থেকে অনেক বুদ্ধিমান। তিনি বিনা যুদ্ধে কেবলমাত্র বিবাহ করে অর্ধেক রাজপুতনা জয় করে ফেলেছিলেন। পরবর্তিকালে তিনি বিকানির ও জয়সলমীরের রাজকন্যাকেও বিবাহ করেন। আকবরের প্রিয় পুত্র ছিলেন দানিয়েল মির্জা। তার মায়ের নাম জানা যায়নি। আকবরের সাথে তার বড় পুত্র সেলিমের কোনওদিনই সদ্ভাব ছিল না। কিন্তু দানিয়েল আকবরকে দাক্ষিনাত্য জয়ে সর্বত ভাবে সাহায্য করেন। এবং পরবর্তিকালে দাক্ষিনাত্যেল শাষনভার আকবর তার হাতেই দেন। আকবর আরও ন'জন মানুষের ওপর খুব নির্ভর করতেন তাঁরা হলেন লেখক ও ইতিহাসবিদ আবুল ফজল,গায়ক তানসেন, প্রধান সেনাপতি মানসিং,অর্থমন্ত্রী তোডরমল, বিদুষক বীরবল, বৈরাম খান পুত্র বিদ্যান আবদুল রহিম,কবি ফৌজি যিনি আবুল ফজলের দাদা ছিলেন, মোল্লা দো পেয়াজা আর এক বিদুষক ও বীরবলের প্রতিদ্বন্দি এবং পরামর্শদাতা ফকির আজিওদ্দিন- যাঁরা একত্রে 'নবরত্ন' বলে পরিচিত ছিলেন। আকবর 3রা অক্টোবর 1605-এ এক dysentery তে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পরেন ও 27 শে অক্টোবর 1605-এ মারা যান। আকবর শেষ জীবনে মানষিক ভাবে ভেঙ্গে পরেছিলেন। কারন তাঁর কাছের মানুষরা অর্থ্যাৎ তার নবরত্নের রত্নরা একে একে মারা যান এবং সুযোগ বুঝে রাজকুমার সেলিম বিদ্রোহ করে বসেন। জাহাঙ্গীরনামা অনুযায়ি আকবরের বাকি দুই পুত্র মুরাদ মির্জা সুলতান এবং দানিয়েল মির্জা ছিলেন রাজ দাসীর পুত্র তাই তারা সিংহাসনে বসার যোগ্য নয়। মুরাদ সিংহাসন নিয়ে উৎসাহি ছিলেন না। শেষজীবনে তিনি তার বাবার সাথেই কাটিয়ছেন।আকবর দানিয়েলকেই শাসক হিসাবে উপযুক্ত মনে করতেন। তাই দোটানার মধ্যে পরে যুবরাজ সেলিমের 36বছর বয়স হয়ে গেলেও রাজ্যাভিষেক হয়নি। সেলিম তার মায়ের সমর্থন না পেলেও তার দুই সৎমা রুকাইয়া এবং সলিমার সমর্থনে আকবর মারা যাবার 8দিন বাদেই 3রা নভেম্বর সিংহাসনে বসেন।জাহাঙ্গীর এতটাই ক্ষমতালোভী ছিলেন যে নিজের বিদ্রোহি বড় পুত্র খসরুকে অন্ধ করে দিতেও এতটুকু হাত কাপেনি এবং পরে শাহ্জাহান একে হত্যা করেন। জাহাঙ্গীরের মামা আম্বের রাজা ভগবান দাসের মেয়ে মনভাবতী বাঈ-এর সাথে বিবাহ হয়।জাহাঙ্গীর তার নাম দেন শাহ্ বেগম আর তার সন্তান হয় খুসরু মির্জা। যেহেতু মা ছিলেন রাজপুত, হয়তো সেই কারনেই জাহাঙ্গির বেশ কয়েকজন রাজপুত রাজকুমারিকে বিবাহ করেন। তার মধ্যে উল্লখযোগ্য ছিলেন মারওয়া-র বর্তমানে যোধপুর-এর রাজকন্যা উদয় সিং-এর কন্যা 'যোধবাঈ'। যোধাবাঈ নয় কিন্তু! পরবর্তিকালে ইনি পরিচিত হন জগৎ গোসাইনি নামে। ইনিই জনাম দেন পরবর্তী সম্রাট শাহ্ জাহান কে।ইনি জাহাঙ্গীরের প্রিয় রানি ছিলেন যতদিন না নুর জাহান কে জাহিঙ্গীর বিয়ে করেন। 1611তে নুর জাহানেল সাথে বিবাহ হয় আল 1619-এ জগৎ মারা যান। মৃত্যুর পর ইনি বিলকিস মাকানি উপাধি পান। ইনি কিন্তু পাটরানী ছিলেন না। পাটরানি বা সম্রাঙ্গী ছিলেন সালিহা বানু বেগম যিনি জাহাঙ্গীরের প্রথম স্ত্রী ছিলেন। 1605 থেকে 1620-তার মৃত্যু পর্য্যন্ত এই পদটি ইনিই অলংকৃত করেছেন। 1620 তে ইনি মারা যাবার পর নুরজাহান সম্রাঙ্গির পদটি পান।28শে অক্টোবর 1627 সালে 58বছর বয়সে ঠান্ডালেগে কাশ্মীরে জাহাঙ্গীর মারা যায়। জগৎ প্রথমে তিনটী কন্যা সন্তানের জন্ম দেন কিন্তু তিনটিই শিশু অবস্থাতেই মারা যায় তাই যেই মুহূর্তে খুরমের জন্ম হয় 6 দিন বয়সে আকবর রুকাইয়ার কাছে খুরম কে প্রেরণ করেন। রুকাইয়ির কাছেই শাহজাহান মানুষ হন। শাহ্জাহান আর মুমতাজের ঘটনা নতুন করে বলার কিছু নেই। শাহ্জাহান এত আড়ম্বর প্রিয় ছিলেন যে অগাধ অর্থ খরচ করে রাজকোষ প্রায় শূন্য করে ফেলেন।তখন তার পুত্র ঔরঙ্গজেব আগ্রাফোর্টে বন্দী করে ফেলেন কিন্তু শাহ্জাহান আত্মসমর্পন না করায় যমুনার থেকে কেল্লায় জল সরবরাহ পদ্ধতিটি বন্ধ করে দেন। শাহজাহান আত্মসমরপন করতে বাধ্য হন। শেষ পাঁচ বছর এখানেই বন্দী থাকেন তিনি।
পরের পর্বে এঁনাদের সৃষ্টির ঐতিহাসিক কাহিনি জানাবো।

দিল্লী-আগ্রা চতুর্থদিন 12/10/17 অষ্টম পর্ব


আমাদের দিল্লী যাবার বাস আগেই বুক করাছিল। আগ্রার হোটেলের টাকা মিটিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। যথাসময় বাস ছাড়লো।
বাস ছুটে চলেছে দিল্লীর দিকে আর আমি ডুবে গেলাম ইতিহাসে। ইতিহাস চিরকাল আমার প্রিয়। তাই কোথাও যাবার সময় সেখানার বিষয়ে আদ্যপান্ত জেনে তবেই আমি পা রাখি। আজকাল কিছু জানতে হলে, কোনও অসুবিধা নেই নেট দেখো। তবে নেট দুনিয়ায় প্রচুর ভাওতাবাজি আছে। ভুলভাল তত্ত্বে পূর্ন করে একটা ডকুমেনট্রি বা একটা পেজ খুলে ফেললেই হল। জনগন খাবে ভাল! Wikipedia কে নির্ভরযোগ্য বলা যেতে পারে। তবে আমি মোগল ইতিহাস জানতে নির্ভর করেছি, বাবরনামা-যেটি বাবর নিজেই লিখেছিলেন, হুমায়ুননামা-যেটি বাবর কন্যা এবং হুমায়ুনের বোন গুলবদন বেগম লিখেছিলেন, আকবর নামা এবং আইন-ই-আকবরি- দুটিই লিখেছিলেন আকবরের বন্ধু তথা 'নবরত্ন'এর একজন, আর তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরি-যেটি লিখেছিলেন জাহাঙ্গীর নিজেই, এইবইগুলিল ওপরেই নির্ভর করেছি। আসল গুলির হিন্দি অনুবাদগুলোই আমাকে জানতে সাহায্য করেছে।
মনে প্রশ্ন জেগেছিল কিভাবে এই আগ্রাফোর্ট, তাজমহল, দিল্লী লালকেল্লা পেয়েছি। জানতে হলে চলে যেতে হয় সেই 1495 সালে যখন 12 বছরের বাবর বসেছিলেন ফেরজানার মসনদে তার বাবার মৃত্যুর পর। আত্মীয়স্বজনের বিরোধিতায় জেরবার বাবর এর দুবছর বাদে সমরখন্দ জয় করলেন। কিন্তু হাত থেকে ফেরজানা বেরিয়ে যায়।1501-এ ফেরজানা আবার জয় করলেন তো সমরখন্দ হাত থেকে বেরিয়ে গেল।অবশেষে 1504 -এ তিনি দুটিই জয় করেন।এরপর কাবুলও তিনি জয় করেন। কিন্ত এইভাবে বাবর সুখি ছিলেন না। তার স্বপ্ন ছিল একছত্র অধিপতি হবার। তখন তার নজর পড়ে উত্তর ভারতের দিকে। সেখানে তখন ইব্রাহিম লোদি ক্ষমতায়।1526-এ প্রথম পানিপথের যুদ্ধে লোদিকে পরাস্ত করে দিল্লীর মসনদে বসে মোগল সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। যেহেতু আমি ইতিহাস বই লিখতে বসিনি তাই বিশেষ detail-এ যাচ্ছিনা। বাবরের তৃতীয় স্ত্রী মহাম বেগমের সন্তান ছিলেন হুমায়ুন। প্রথম স্ত্রী আয়সা সুলতান বেগমের ছিল একটি কন্যা আর দ্বিতীয় স্ত্রী জৈনব সুলতান বেগম নিঃসন্তান অবস্থায় বিয়ের দুবছরের মধ্যেই মারা যান।বাবর খুব কম বয়সে মাত্র 47 বছর বয়সে 1530সালে মারা যান। কেন এবং কিভাবে তা সকলেরই জানা।
পিতার মৃত্যুর পর 23 বছর বয়সে অনভিঞ্জ হুমায়ুন ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু অনভিঞ্জতার কারনে একে একে সব হাত ছারা হয়ে যায় সৎ ভাই আর শের শাহ্ সুরির কাছে। 15 বছর পর এক এক করে সব আবার তিনি জয় করেন।পিতার মত তিনিও 47 বছর বয়সে 1556 সালে মারা যান। দু হাতে বই নিয়ে তাঁর গ্রন্থাগার থেকে নামছিলেন। সেইসময়ে আজানের ডাক আসে। তাঁর অভ্যাস ছিল যে অবস্থাতেই তিনি থাকুন না কেন হাটু গেড়ে বসে পরতেন। সেই প্রচেস্টা করতে গিয়ে পোশাকে পা জড়িয়ে সিঁড়ি থেকে পড়ে যান এবং তার ঠিক তিন দিন বাদে তাঁর মৃত্যু হয়। হুমায়ুনের প্রথমা স্ত্রী বেগাবেগম ছিলেন হুমায়ুনের মামাতো বোন। তার সন্তান আল-আমন-মির্জা ছিল হুমায়ুনের প্রথম সন্তান কিন্তু সে শিশুকালেই মারা যায়। এরপর দ্বিতীয় স্ত্রী হামিদা বানু বেগমের সন্তান হয় আকবর।
1542 সালে যখন হুমায়ুন তাঁর পরিবার সহ সিন্ধের ওমরকোট দূর্গে হিন্দু রাজা রানা প্রসাদের আশ্রিত ছিলেন, সেই সময় আকবরের জন্ম হয়। হুমায়ুন যখন সাম্রাজ্য হারিয়ে আশ্রিত হয়ে রয়েছেন সেই সময় তার সৎ ভাই কামরান মির্জা আর আসকারি মির্জা আকবরকে কাবুল নিয়ে যান। সেখানে সমস্ত রকম তালিম পান আকবর কিন্তু লেখাপড়া তিনি শেখার সুযোগ পাননি। 1551 সালে হুমায়ুনের প্রিয় ভ্রাতা হিন্দল মির্জা এক যুদ্ধে মারা যান। এতে হুমায়ুন খুব ভেঙ্গে পরেন এবং হিন্দল মির্জার ন'বছরের কন্যা রুকাইয়া বেগমের সাথে ন'বছরের আকবরের বিবাহ দেন।আকবরের কথা বলতে গেলেই খুব স্বাভাবিক ভাবে বৈরাম খানের কথা চলে আসে। বৈরাম খাঁ ছিলেন হুমায়ুনের খুবই বিশ্বস্ত এবং হুমায়ুনের অবর্তমানে আকবরের অভিভাবক হয়ে মোগলদের নুয়ে যাওয়া ধ্বজা তুলে ধরেন।বৈরাম খাঁ 16বছর বয়সে বাবরের সেনাবাহীনিতে যোগ দেন আর নিজের দক্ষতায় ধীরে ধীরে হুমায়ুনের প্রধান সেনাপতিতে উন্নিত হন। হুমায়ুনের অকস্মাৎ মৃত্যুতে দিল্লীর সিংহাসন টলমল হয়ে পরে। ন'মাস বাদে 7ই অক্টোবর 1556 হিন্দুরাজা হিমু দিল্লী আক্রমণ করে বসে।এর ঠিক এক মাস বাদে 5ই নভেম্বর 1556 তে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে বৈরাম খানের সেনা হিমুর একটি চোখ কানা করে পরাস্ত এবং পরে হত্যা করে।নাবালক আকবর কে সিংহাসনে বসিয়ে অভিভাবক হয়ে কাজ করতে থাকেন বৈরাম খান। কিন্তু আকবরের সাথে মতের মিল না হওয়ায় বৈরাম খানকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে বলা হয়। বৈরাম খান যখন স্ত্রী পুত্র নিয়ে মক্কা শরিফ রওনা হন তখন হিমুর সহচর হাজি খান মেওয়াটি হিমুর হত্যার প্রতিশোধ নিতে বৈরাম খান কে হত্যা করেন এবং তাঁর স্ত্রী সলিমা বেগম ও পুত্র রহিমকে আগ্রা পাঠিয়ে দেয়।পরবর্তীকালে সলিমা বেগমকে আকবর নিকাহ্ করেন এবং রহিম রাজসভায় নবরত্নদের মধ্যে একজন হয়।
বাকি অংশ জানাচ্ছি পরের পর্বে.....

দিল্লী-আগ্রা তৃতীয়দিন 11/10/17 সপ্তম পর্ব


গাড়ী ছুটে চলেছে আগ্রার দিকে।মন কিন্তু পড়ে রয়েছে ফতেহপুর সিক্রীতেই।কি আশ্চর্য্য, কি অভাবনীয় যে কত হাজার বছর আগে একজন মানুষ তার জীবনের লড়াইটা এখান থেকে শুরু করে এখানেই শেষ করেছিলেন। আর আমরা এত বছর পরে তার ভগ্নাবশেষ দেখছি। যখন তিনি তৈরী করেছিলেন তখন তিনি ভাবেনও নি যে তার তৈরি এইসব থাকার জায়গা কেউ অবাক বিস্ময়ে দেখবে।
চড়া রোদ্দুরে মাথা ব্যাথাটা আরও বেড়েছিল। মায়ের কাছে একটা ছাতা ছিল কিন্তু সে ছাতাও আমার মাথা ব্যাথার কিছুমাত্র আরাম দিতে পারেনি।রাজা উঠেই বলেছিল ড্রইভারকে একটা খাবার জায়গা দেখে দাঁড়াতে। একটা পাঞ্জাবী ধাবা দেখে গাড়ী দাড়াঁলো। খাবার দাবার খুব ভাল ছিল, মালিকও খুব যত্নবান ছিল। আমি অল্প স্যুপ খেলাম। আবার গিয়ে চড়লাম গাড়ি। আমার শরীরটা চাইছিল ঘুম। জানলায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরলাম।
আগ্রায় ঢুকেছি বোঝা যায় একটা জিনিষেই, অজস্র লালমুখো বাঁদরের উপস্থিতিতে। আগ্রার বিখ্যাত মিঠাই হল 'পেঠা'। এটা আর কিছুই না সিম্পলি 'আনারসের মোরব্বা'। তবে রাজার এক নেশা আছে যেখানে যাবে সেখানকার সব কিছু কিনবে এবং খাবে। তাই পেঠাও তাকে নিতেই হবে। এখানকার পঞ্ছী পেঠা প্রসিদ্ধ। তারই একটা দোকানের সামনে নিয়ে ড্রাইভার দাঁড় করালো। আমরা পেঠা কিনে হোটেলের উদ্দ্শ্যে রওনা দিলাম।
কাল আমরা রওনা দেব দিল্লী কিন্তু আমার মন খারাপ হয়েযাচ্ছিলো। আরও কিছুদিন যদি থাকা যেত ! আরও একটু ভালো করে দেখা যেত! সময়াভাবে এই ঝটিকা সফর, মন ঠিক মানলো না। তবে এইটুকু শান্তনা পেলাম যে, যে সব জায়গা,স্মৃতিসৌধ দেখতে বিদেশীরা ভীড় জমায়, সে সব কিছু নিজের দেশে থাকা সত্ত্বেও দেখিনি, আজ দেখলাম। আজ দেখলাম সেই ইতিহাস মোড়া শহর কে। বিদায় আগ্রা! যুগযুগ ধরে বাঁচিয়ে রেখো তোমার এই ইতিহাসের নায়কদের।

দিল্লী-আগ্রা তৃতীয়দিন 11/10/17 ষষ্ঠ পর্ব


কেল্লা থেকে বেরিয়ে গাইড বিদায় নিল। সে শুধু আমাদের যোধাবাঈ মহল যাবার রাস্তাটা দেখিয়ে দিল। আমরা টিকিট কেটে প্রবেশ করলাম। রোদের সাথে সাথে আমার মাথাব্যাথাও চরছিল। মাথার একটা বিশেষ জায়গায় চাটি মারলে ব্যাথাটা খানিক প্রশমিত হয়। আমি মাঝেমাঝেই সেটা করছিলাম। হঠাৎ দেখি এক বিদেশিনী অবাক চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। বুঝলাম ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। শেষে হয়তো আগ্রা পাগলাগারদেই চালান হয়ে যাব!
আকবর মানেই তো লাল বেলে পাথর, এখানেও তার উপস্থিতি। পাথরে সুন্দরconstruction আর নকশা দুটো দেখলেই বলে দিতে হয় না যে এ নিশ্চিত ভাবে যোধাবাঈ মহল। কারণ এতে রয়েছে রাজস্থানি শিল্পকলার ছোঁয়া। অবশ্য আকবর নিজেও একপ্রকার রাজপুত বলা যেতে পারে। কারণ আকবরের জন্ম হয়েছিল এক রাজপুতের ঘরেই এবং ছোট থেকে বালক হওয়া সেখানেই। তাই রাজস্থানি রহন-সহন তাঁর মজ্জা গত ছিল,রক্ত তার মোগল হলেও। জানলা, কুলুঙ্গি, ঠাকুরের আসন সব কিছুতেই রাজস্থানি শিল্পকলার ছাপ সুস্পষ্ট। একতলা, দোতলায় পুরোমহল সুবিন্যস্ত। মহল টা ছিল ঠিক আগেকার দিনের জমিদার বাড়ীর মত। মাঝখানে বিশাল প্রশস্ত এলাকা আর চারপাশে ঘর। মহল থেকে বেরিয়ে শাহী রান্নাঘর। যদিও সেটি তালাবন্ধ থাকার কারণে আমরা ভিতরে ঢুকে দেখতে পেলাম না। এরপর এক এক করে পঞ্চমহল, অনুপ তালাও, দেওয়ানি আম দেওয়ানি খাস দেখলাম। সব থেকে interesting লেগেছিল কোষাগার। দেওয়াল লাগোয়া ছোট ছোট চৌবাচ্চার মত। উপরটা টেবিলের মত তার মাঝখানে 12ইঞ্চি/12ইঞ্চি গর্ত, যেটা আবার পাথরের স্লাইডিং ঢাকা দেওয়া। মেঝেতেও একটা বড় আয়তকার পাথর আলগা। তাতে একটা গোলাকার ছোট গর্ত। অনুমান করা যায় ঐ গর্তর মধ্যে কিছু ঢুকিয়ে চাড় দিয়ে খোলা হত।
দেওয়ানি খাসের মাঝখানে রয়েছে লোটাস পিলার। সুন্দর পাথরের নকসা তাতে। পঞ্চমহলে বসে রানীরা হাওয়া খেতেন। অনুপ তালাবের জল এখন শ্যাওলা ধরা হলেও একসময় নিশ্চই স্বচ্ছ ছিল। এর মাঝখানে এক বেশ বড় বসার জায়গা। জানা যায় ওখানে তানসেন গাইতেন। অনুপ তালাবের জল ছাড়া এখানে আর কোন জলের অস্তিত্ব নেই। এমনকি কোনও ফোয়ারা জাতিয় কিছু দেখলাম না। বোঝাযায় এখানে জলের উৎস হিসাবে বৃষ্টির উপরই নির্ভর করতে হত।
আকবর চিরকালই ফতেহপুর সিক্রীকে রাজধানি হিসেবে পছন্দ করতেন। প্রথমদিকে তাই করাও হয়েছিল। কিনতু নানান প্রদেশের বিদ্রোহ সামাল দেওয়া ফতেপুর সিক্রী থেকে অসুবিধা ছিল। প্রধান বাধা ছিল যাতায়াত। তাই সেইসময় রাজধানি আগ্রাতে স্থানান্তরিত করা হয়। শেষ জীবনে আবার তিনি ফতেপুর সিক্রী ফিরে যান এবং সেখানেই তিনি মারা যান।
আমাদের গাড়ির ড্রাইভার তাড়া দিচ্ছিল। তাই আমরা বেরিয়ে এলাম। পিছনে পড়ে রইল ইতিহাসের এক বিশাল অধ্যায়। অটো করে গাড়ীর কাছে পৌছলাম। গাড়ীতে চেপে পিছন ফিরে একবার কেল্লার দিকে ফিরে তাকালাম। সম্রাট আকবরের স্নেহধন্যা এই কেল্লা একা পরে আছে বছরের পর বছর। না জানি আরও কত বছর পরে থাকবে এই সুবিশাল আকাশের নীচে নিসঙ্গ একাকী।

দিল্লী-আগ্রা তৃতীয়দিন 11/10/17 পঞ্চমপর্ব


সকালে ঘুম ভাঙ্গলো রাজার ডাকে। গাড়ি নাকি আটটায় চলে আসবে অতএব তাড়াতাড়ি ওঠো। দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দেখি মা বাবা হাসিমুখে ছাদের সিড়ি দিয়ে নামছে। বলা হয়নি আমাদের হোটেলে রুফটপ রেস্ট্রোরেন্ট ছিল। যেখান থেকে তাজ দেখা যেত। মা বাব সেখান থেকেই ফটো তুলে নামছিল
আজ আমাদের ফতেপুর সিক্রী যাবার কথা। রাজা গতকাল গাড়ী ঠিক করে রেখেছিল। আমরা ব্রেকফাস্ট করে বেড়িয়ে পড়লাম। তবে আমি কিছু খাইনি, আগেরদিন থেকে আমার মাইগ্রেনের পেইন শুরু হয়েছে, খেলে হিতে বিপরিত।
বেশীক্ষণ নয় দেড় ঘন্টা লাগলো। গাড়ী আমাদের একজায়গায় নামালো তার থেকে বেশী যাবার তার অনুমতি নাই। আমরা একটা গাইড ঠিক করে তার ঠিক করা অটোতে চেপে বসলাম। তিন মিনিটে অটো থামলো একটা ছোট টিলার নীচে। যেখান থেকে ঢালু রাস্তা উঠে গেছে টিলার ওপরে কেল্লা পর্য্যন্ত। আমরা হাঁটা শুরু করলাম। গাইডের খুব তাড়া। আমাদের তাড়া দিয়েই চলেছে। কিন্তু আমরা তার কথায় কর্ণপাত না করে গজেন্দ্র গমনে গিয়ে পৌছলাম কেল্লার সামনে। ওরে বাবা সামনে গিয়ে দেখি দোতলা সমান উচ্চতা ওঠার জন্য খাঁড়া, সিঁড়ি নয়, ঢালু রাস্তা। উঠে এলাম। সবাই এখানে জুতো খুলছে কারণ ভিতরে সেলিম চিস্তির সমাধি মন্দির। আমাদের গাইডের পরিচিত একজনের হাওয়ালে জুতো রেখে আমরা গাইডের পিছু নিলাম। আমরা যেখান দিয়ে ঢুকলাম সেটিও একটি বড় গেট তবে সেটি বুলন্দ দরয়াজা নয়। ভিতরে ঢুকে দেখলাম এক সুবিশাল প্রশস্ত জায়গার এক কোনে সেলিম চিস্তির সমাধি মন্দির, সাদা মার্বেলে ঝক ঝক করছে। আর রয়েছে একটি মসজিদ। পুরো এলাকাটা ঘিরে রয়েছে ছোট ছোট ঘরে। গাইড বলল ওগুলো আকবরের তৈরী মেয়েদের জন্য মাদ্রাসা। ওখানে বেশ অনেকগুলি কবর দেখলাম। সেগুলি সবই সেলিম চিস্তির পরিবার পরিজনদের। স্থানীয় পসারীরা নানারকম মার্বেল পাথরের পসরা নিয়ে বসেছিল। সবচেয়ে খারাপ লাগলো 'সেলিম চিস্তির সমাধিতে চাদর চরানো' একটা ব্যবসা এখানে। প্রথমে বলে নেবে চাদর চড়ালে অমুক-তমুক ভালো হবে। তারপর তার দাম হাঁকবে, আটহাজার, পাঁচহাজার, এক হাজার। গাইড আমাদের একটি দরজা দেখালো যেটা সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে। ওটি একটি সুরঙ্গের প্রবেশ পথ। ওটার সাথে সংযোগ আছে আগ্রা ও লাহোর ফোর্টের। ইতিহাস বলে আকবরের প্রথম স্ত্রী রুকাইয়া বেগম আনারকলিকে ওই পথ দিয়েই পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন। গাইড নানারকম স্থানিয় ঘটনার কথা বলতে বলতে পসারিদের পাশ কাটিয়ে কেল্লার বাইরের দিকে নিয়ে এল। দূরে লাইট হাউসের মত দেখতে একটা জিনিস দেখালো। ওটা আকবরের প্রিয় হাতি সমাধি। আমরা আকবরের টাঁকশালও দেখলাম। আমাদের বাঁ দিকের কতগুলো construction দেখিয়ে গাইড বলল ওটা যোধাবাঈ মহল। কেল্লা আর যোধাবাঈ মহলের যে ফারাক, সেটা এখন গাছপালায় ভর্তি হয়ে গেলেও ওটা কেল্লার মধ্যেই ছিল। কিন্তু এখন মনে হয় দুটোই আলাদা। কেল্লার গায়ে ছোটছোট খুপরি করা হয়েছিল সে সময়কার ডাকহরকরা পায়রাদের জন্য। গাইড এবার আমাদের নিয়ে এল বুলন্দ দরয়াজার সামনে। দরজার গায়ে ছোটবড় নানান সাইজের ঘোড়ার নাল লাগানো। জানলাম আকবরের সময় থেকে কারও ঘোড়া অসুস্থ হলে সেলিম চিস্তির সমাধিতে মানত করতো, ঘোড়া সুস্থ হয়ে গেলে তার নাল ঐ দরজায় লাগিয়ে দিত। এই দরজা দিয়ে সম্রাট আকবর ঢুকতেন আর সাধারনের জন্য অন্য দরজা, যেখান দিয়ে আমরা ঢুকলাম। সে নিয়ম আজও চলছে, শুধু সম্রাটই আর নেই । বাস্তব থেকে বেখবর বুলন্দ দরজা যেন এখনও তার সম্রাটের অপেক্ষায় রোজ দরজা খুলে চেয়ে থাকে পথের দিকে। কিন্তু তার সম্রাট তো আজ ইতিহাস!