Thursday, 27 September 2018

দিল্লী-আগ্রা চতুর্থদিন দশম পর্ব


যদিও মোগোল বংশ এক বিশাল বংশ। তাদের সবাইকে কি আমরা জানি? আমরা শুধু ঔরঙ্গজেব পর্য্যন্ত জেনে এসেছি। আর দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ জাফরকে জানি কারণ তিনি ছিলেন শেষ মোগল সম্রাট। এদের সকলের মধ্যে আমরা মনে রেখেছি শুধু দুজনকে আকবর আর শাহ্জাহান। আকবরের সৃষ্টি ফতেহ্পুর সিক্রী আমরা দেখেছি। আমরা শাহ্জাহানের সৃষ্টি তাজমহলও দেখেছি। অনেকেই জানেন না যে দিল্লী লাল কেল্লা শাহ্জাহানেরই সৃষ্টি। সে যাই হোক প্রথমে আসি আগ্রা ফোর্টের কথায়।
আগ্রা ফোর্ট 380,000 স্কোয়ারমিটার অর্দ্ধ গোলাকৃতি একটি 4গেট যুক্ত ফোর্ট। খিজরি গেটটি যমুনার দিকে খোলে। দূর্গের পশ্চিম দিকে গেট যেটি শহর মুখী সেটি দিল্লী গেট। এটি 1568 সালে তৈরী হয় নিরাপত্তা ও সম্রাটের নিজস্ব প্রবেশ দ্বার হিসেবে।এই গেটটি পরবতী কালে শ্বেত পাথর দিয়ে নতুন করে অলঙ্কৃত হয়। এই গেটের ভিতরের দিকে দুটি প্রমাণ সাইজের পাথরের হাতি রাখা হয়েছিল তাই একে 'হাথিপোল'ও বলা হত। আর একটি গেট ছিল লাহোর গেট যেটি পরবর্তীকালে অমর সিং গেট বলে খ্যাত হয় এবং সেটিই জনগনের প্রবেশ দ্বার। দিল্লীগেট এখন ইন্ডিয়ান আর্মির অধিন।সাধারনের প্রবেশ নিষেধ।
1526-এ প্রথম পানিপথের যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদিকে হারিয়ে বাবর এই দূর্গে বাস করতে শুরু করেন।পানীয় জলের জন্য তিনি একটি বাওলি তৈরী করেন। যার উপস্থিতি এখনও আছে দেওয়ানি আম-এর সামনে।তারপর বিভিন্ন সময় মালিকানা বদল হয়েছে।আকবরের সময় থেকে এটি বংশ পরম্পরায় মোগলদের হয়। আবুল ফজল তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছিলেন যে এই দূর্গ পূর্বে বাদলগড় নামে পরিচিত একটি ইটের তৈরী দূর্গ ছিল। আকবর যখন আগ্রাকে রাজধানী হিসাবে ঘোষণা করেন তখন এটি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। রাজস্থানের বারাউলি থেকে লাল বেলে পাথর নিয়ে এসে নতুন করে এটি তৈরী শুরু হয়। 1573 সালে নতুন দুর্গটি সম্পূর্ণ হয়। আমরা এখন অবস্থায় দেখি তার প্রায় বেশিরভাগ শাহ্জাহানের সময়েই হয়। তিনি নিজের মহল তৈরীর জন্য আকবরের সময়কার বেশকিছু স্থাপত্য ভেঙ্গে ফেলেন। ঔরঙ্গজেব রাজধানি দিল্লীতে স্থানান্তরিত করার ফলে এই দূর্গে আর বাস করেন নি। পরবর্তী মোগল শাসকরা দিল্লী লাল কেল্লাতেই থাকতেন। এরপর এটি মারাঠাদের দখলে চলে যায়। আর তারপর ইংরেজ দের দখলে।
গেট দিয়ে ঢুকেই প্রথমে বেঙ্গলী মহল। যেটি পরে আকবরি মহল ও জাহাঙ্গিরি মহলে বিভক্ত হয়ে যায়।জাহাঙ্গির তাঁর বইতে এই মহলের উল্লেখ করেন। কিন্তু এই ব্যাপারে তিনি তার পিতাকেই প্রসংসিত করেছেন। পরবর্তীকালে নুরজাহান এই প্রাসাদে তার মৃত্যু পর্য্যন্ত বাস করে গিয়েছিলেন। তাই এখন এটি নুর জাহান মহল নামেই পরিচিত।
আকবরের পছন্দের স্থান কিন্তু আগ্রা ছিল না, ছিল ফতেহ্পুর সিক্রী।ফতেহ্ কথাটা শুনেই বোঝা যায় যে এখানে জয়ের কোনও ইতিহাস আছে। ঠিক তাই, চিতোর এবং রনোথম্বর জয়ের পর আকবর 1569-এ একটী নতুন জায়গায় রাজধানি সরিয়ে নিয়ে যেতে চান। সে হল আগ্রা থেকে 37 কি.মি দূরে বর্তমানের ফতেহ্পুর সিক্রী। তখন এর নাম ছিল ফতেহ্ বাদ। এই জায়গা শুধু আকবরের নয় তার পিতামহ বাবরেরও পছন্দের ছিল। এই পরকল্পিত শহরের বাইরে বাবর একটি বাগান তৈরী করেছিলেন রানা সঙ্গকে পরাস্ত করার পর। 1585তে অপর্যাপ্ত জল এবং আরও নানা কারণে আকবর তার রাজধানী লাহোরে স্থানান্তরিত করেন। কিন্তু 1601-এ আবার তিনি ফিরে আসেন এখানে।তাঁর মৃত্যুবধি তিনি এখানেই রাজধানী রেখেছিলেন। এরপর জাহাঙ্গীর এবং শাহ্জাহান আগ্রাতেই রাজধানী বহাল রেখেছিলেন আর ঔরঙ্গজেব দিল্লীতে।ইতিহাসে তখন ফতেহ্পুর সিক্রীর কথা জানা যায়নি। এরপর আবার ফতেহ্পুর সিক্রীর উল্লেখ পাওয়া যায় অন্যতম সৈয়দ ভাইয়ের খুন হওয়া থেকে। প্রশ্ন আসে কে এই সৈয়দ ভাই? সৈয়দ ভাইরা ছিলেন দুই ভাই সৈয়দ হাসান আলি খান ও সৈয়দ হুসেন আলি খান। বলা যেতে পারে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মোগল রাজনিতীর ভাগডোর এই দুই ভাইয়ের হাতেই চলে যায়। এই দুই ভাই ছিল ঔরঙ্গজেবের আইনসভার খুব গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকার। 1710-এ ঔরঙ্গজের মারা যাবার পর প্রথম বাহাদুর শাহ্ তার ভাইদের পরাস্ত করে সিংহাসন অধিকার করে সৈয়দ ভাইদের সাহায্যে।1712-তে বাহাদুর শাহ্ মারা গেলে তার উত্তরাধিকার জাহানদার শাহ্ কে সৈয়দ ভাইদের নির্দেশে হত্যা করে জাহানদারের ভাগ্নে ফারুকশিয়ারকে 1713-তে সিংহাসনে বসায়। ফারুকশিয়ার সৈয়দ ভাইদের তুষ্ট করতে না পারায় তাকে অন্ধ করে হত্যা করে এবং ফারুকশিয়ারের বড় খুরতুতো ভাই রফি উদ দারাজাতকে 1719-এর ফেব্রুয়রিতে সিংহাসনে বসায় দুই ভাই।দারাজাত ঐ বছর জুন মাসে ফুসফুসের রোগে মারা গেলে তার ভাই রফিউদদৌল্লা(দ্বিতীয় শাহ্জাহান )কে বসানো হয়, সেও ঐ একই রোগে সেই বছর সেপ্টেম্বরে মারা যায়।তখন তার 17 বছরের ছেলে মহম্মদ শাহ্কে সৈয়দ ভাইরা সিংহাসনে বসায়। 1720-তে মহম্মদ শাহ্ হুসেন আলিকে ফতেহ্পুর সিক্রীতে খুন করে এবং হাসান আলিকে বিষ প্রয়োগ করে মারা হয়। এখান থেকে আবার ফতেহপুর সিক্রীর উল্লেখ পাওয়া যায়। বাকি আবার পরের পর্বে জানাব।

No comments:

Post a Comment