Monday, 24 October 2016

কুকুর-কাহিনী

প্রত্যেক পাড়ায় একটা-দুটো শুটকো ছেলে থাকে যারা পাড়ার মা-বোনেদের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নেয়। উটকো ছেলে পাড়ায় ঢুকলে সরু লিকপিকে চেহারা নিয়ে এগিয়ে গিয়ে বিশাল বড় বড় বাতেল্লা ঝারে। কিন্তু প্রতিপক্ষ একবার চোখ কুচকালেই কিন্তু প্রাণপাখি ডানা মেলে।

আমাদের পাড়ার ঠিক এইরকম দুটি চ্যাংরা কুকুর আছে। কুকুর মানে কিন্তু আমি চতুস্পদ প্রাণী ‘ডগ’এর কথাই বলছি। একটা কালো একটা সাদা। চ্যাংরা এইকারনেই বলছি, পাড়ার মুদিদোকান থেকে বেড়োলেই পিছন পিছন হাটতে থাকবে যতক্ষন না বাড়ীর গেট খুলে ঢুকি। বারান্দায় দাঁড়ালে হাঁ করে উপর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।

কোনও কুকুর যদি পাড়া দিয়ে ‘পাস’ করে তো শুরু হয়ে যাবে ওর ঘৌঘৌ। আর একবার যদি শুরু করলো তো যতক্ষণ না লাঠি নিয়ে তেড়ে যাব ততক্ষণ ঘৌঘৌ করেই যাবে। একদিন মাঝরাতে ঠিক আমরই জানলার নীচে শুরু করেছে ওর পোঁ। কিছুতেই আর থামেনা, একঘন্টার ওপর হয়ে গেছে ঘৌঘৌ করেই চলেছে। বাবুই রেগেমেগে খাটে উঠে বসে বলল,“মনে হচ্ছে ওর পিছনে ক্যাৎ করে এক লাথ মারি”। আমি আর বাবুই নীচে লাঠি নিয়ে নেমে এলাম। লাঠি দেখে চোঁ চাঁ দৌড় দিয়ে পগাড় পার। মনে মনে বললাম ‘বাঁচা গেল’। বেশ কিছুদিন চুপচাপ।

দিন পনেরো বাদে আবার রাত্রিবেলা এক কিস্সা। কিছুক্ষণ  চলার পর পাশ থেকে বাবুইয়ের বিরক্তিসূচক  নানা আওয়াজ কানে আসতে লাগলো। উঠে বারান্দায় গিয়ে দেখি কেউ কোথ্থাও নেই।  ওটা বারান্দার নীচে দাঁড়িয়ে ডেকেই চলেছে। আমি ঘরে এলাম এক বালতি জল উপর থেকে দিলাম ফেলে। বেশীরভাগ টাই পড়লো রাস্তায়। গরমকাল ছিল বলেই জল থেরাপি কাজে লাগাতে পেরেছি। যাইহোক সে ছত্রভঙ্গ হয়ে পালালো।

এখন ওর ঘৌঘৌয়ের ব্যামো চাপলে আমি বারান্দায় গিয়ে দাড়াই। কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে ‘ভোক-ভোক’ করে তারপর আস্তে আস্তে চলে যায়।

ছোটবেলা থেকে আমি কুকুরকে খুব ভয় পেতাম। কিন্তু দেখা গেল আমার যে বাড়ীতে বিয়ে ঠিক হল সে বাড়ীর অন্যতম মেম্বার একটি জার্মান স্পিৎজ। শুনলাম কুকুরটি আমার সদ্য গত হওয়া হবু শ্বাশুরি মায়ের খুব কাছের। শ্বাশুরি মা চলে যাবার পর সে এখন আমার হবু স্বামী মানে রাজার খুব কাছের। ক্রমশ আমার বিয়ের দিন এগিয়ে আসতে লাগল আর আমার আতঙ্ক বাড়তে লাগল। এইসবের মধ্যে আমার বিয়েও হয়ে গেল। বিয়ের পরের দিন যখন শ্বশুর বাড়ী গেলাম,সমস্ত আচার অনুস্ঠানের পর আমার শ্বশুরমশাই কুকুরটিকে আমার সাথে আলাপ করাতে নিয়ে এলেন। তখন জানলাম ওর নাম ‘ভিকি’। ভিকি আমায় শুঁকলো,পায়ের আঙ্গুল চাটলো চলে গেল। আমি জানিনা ভিকি আমাকে কিভাবে নিল কিন্তু আমি ওর সামনে রাজাকে ছুঁতাম না,এই ভয়ে যে ও যদি রিঅ্যাকট করে! ভিকি কিন্তু সব সময় আমার পিছন পিছন ঘুরতো। আমি খেতে বসলে ও চেয়ারের তলায় বসে থাকত আমি শুতে গেলে আমার খাটের তলায় শুয়ে থাকতো। আমার শ্বশুর মশাইয়ের সংগে আমার বিভিন্ন কারনে বাগবিতণ্ডা হত। উনি আক্রমনাত্মক হলেই ভিকি তেড়ে যেত। এরপর এমন হল উনি আমার কাছাকাছি থাকলেই ভিকি তেড়ে যেত। একবার দুপুরে হঠাৎ  কালবৈশাখী ঝড় উঠল। প্রবল বাজ পড়ছিল।ঘুম একটু হালকা হতেই টের পেলাম ভিকি আমার কোমড়ে ঠেস দিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। সেই প্রথম ওকে আমি বিছানায় উঠতে দেখেছিলাম। এইভাবে ওর সাথে আমার সখ্যতা হয়েগিয়েছিল। আমি কম্পিউটার  ইন্সটিটিউট যেতাম। বিকেলে ফিরে দেখতাম ও আমার জন্য বারান্দায় অপেক্ষা করছে। ও নাকি ঠিক আমার আসার সময় হলেই বারান্দায় গিয়ে বসে থাকত। এইভাবে দুবছর চলল। একদিন সকাল ঘুম থেকে উঠে দেখি ও খুব কাঁপছে। সময়টা ছিল জানুয়ারি মাস ৮তারিখ।  আমি রাজাকে ডেকে তুললাম। রাজা ঘুম থেকে উঠলে ও যে ভাবে রিঅ্যাকট করতো তার কিছুই করল না। সেদিন রবিবার ছিল তাই রাজা আডডা দিতে চলে গেল। যাবার আগে ওকে ছাদে বিছানা পেতে হালকা রোদে শুইয়ে রেখে গেল। আমি বসেরইলাম সামনে যদি ও জল-টল কিছু চায়। ছাদৈ কাক বসলে ও তেড়ে যেত সেদিন কাকে ওর ল্যাজ টানছিল পা টানছিল ও কিচ্ছু বলছিল না। বঝতে পারছিলাম ওর সময় আগত। আমি কাকগুলো তাড়িয়ে রাজাকে ফোন করলাম, তুমি শিগগিরি এসো আমার ভালো ঠেকছেনা। রাজা একটু পরেই দৌড়তে দৌড়তে এল। ছাদে এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল“কি হয়েছে মা,কষ্ট হচ্ছে?” কথা শেষ হতেই ভিকি রাজার হাতের কড়ে আঙ্গুলটা হালকা করে মুখে নিল। কিন্তু দাঁত চেপে বসল রাজার আঙ্গুলে। ভিকি আর নেই! যেই রাজাকে ও কারও সাথে সেয়ার করতে চাইত না, যার কাছে ও দুবেলা খেত,খুনসুটি করত, তার কাছ থেকে শেষ বিদায় টা নিয়েই ভিকি চলে গেল।

Sunday, 23 October 2016

সুখ

শিউলি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল অন্যমনস্কভাবে। পিউ পিছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরলো,“মা আমরা কখন ঠাকুর দেখতে যাব,বাবা কখন আসবে!একটা হোয়াটস অ্যাপ করো না,দেখোনা কোথায় আছে”।
সে কি আর করেনি শিউলি!কিন্তু ম্যাসেজ ডেলিভারই হয়নি। তার মানে ফোন অফ করা। আজ ষস্টি। আজই সবাই ঠাকুর দেখতে বেরচ্ছে। পিউকে রুদ্র বলে গেছে অফিস থেকে এসেই বেরোবে।  কিন্তু এখনও কোনও খবর নেই। অস্থির পায়ে এসে ঘরে বসলো শিউলি। পিউকে একটু জল দিতে বলতেই ডোরবেল বেজে উঠল। পিউ দরজা খুলতেই ধীর পায় মাথা নীচু করে ঢুকলো রুদ্র। ধপাস্ করে সোফায় বসে বলল ““আর চাকরি নেই””

ঘরের মধ্যে যেন পারমাণবিক বোমা পড়ল। শিউলি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই রুদ্র বলল,“ওরা আমার কোনও কথাই শুনলো না,শুধু বলল আর আসতে হবে না। কি কারণ কিছুই বলল না”হতাশ গলায় বলল রুদ্র। পিউ হঠাৎ এই খবর আশা করেনি। বিস্ফরিত চোখে বাবার হতাশ মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। খানিকটা হতাশা,খানিকটা ভয় আর খানিকটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আতঙ্ক সেই দৃষ্টিতে ছিল। আশা শিউলীও করেনি কিন্তু এই মুহূর্তে শুধু মনে হচ্ছিল এই আবহাত্তয়া ঠিক করা একান্ত দরকার। যা হবার তো হয়ে গেছে। অবশ্য অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কিত সেও। কিন্তু ভেবে কিহবে,যা হবে তা ফেস করবো—করতেই হবে!সারাটা বছর এই কটা দিনের অপেক্ষায় বসে থাকা, সারাটা বছর একটু একটু করে তৈরী হওয়া সমস্ত কিছু পন্ড হতে দেওয়া যায় না। রুদ্র বহুবার ‘বেস্ট সেলার’ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। চাকরী ছাড়া ও থাকবেনা শিউলি জানে। রুদ্রকে সব কোম্পানি ডেকে নিয়ে গেছে। তবে চিন্তা কি!
শিউলি উঠে গিয়ে চা বসালো। রুদ্রর সামনে এসে দাঁড়ালে রুদ্র অসহায়ের মত তাকালো শিউলির দিকে।
“আরে তুমি এত হতাশ হচ্ছ কেন!ভুভারতে কি এছাড়া আর কোনও সেলস্ এর জব নেই।” রুদ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল শিউলির মুখের দিকে। “আরে বাবা মনে করনা এটা তোমার পূজা বিরতি!” রুদ্রর মুখ ধীরে ধীরে নর্ম্যাল হতে শুরু করেছে। “তোমাকে আমরা কতটুকু পাই বল!এই ছুতোয় তোমাকে আমরা একটু কাছে পাব। বেড়াব আনন্দ করবো”রুদ্রর মুখ ঝলমল করে উঠলো। ওদিকে চায়ের জল ফুটতে শুরু করেছে। শিউলি উঠে গেল।
চা নিয়ে যখন আবার ড্রইংরুমে ঢুকল আবহাওয়া  বদলে গেছে। রুদ্রকে পিউ মোবাইল  অন করে পূজার ম্যাপ দেখাচ্ছিল অ্যাপ খুলে।
“কিন্তু শিউলি সংসার চলবে কিকরে!” হাতে চা নিয়ে রুদ্র বলল।
“কেন?আমরা কি দিন আনি দিন খাই নাকি? সেভিংস অ্যাকাউন্টে টাকা আছে। দরকার পড়লে ফিকস্ট ভেঙ্গে অল্প নিয়ে আবার ফিকস্ট করে দেবো। অত ভেবনা। ভেবে কিছু হাল বেরোবেনা। জব তুমি ঠিক পেয়ে যাবে। যাও ফ্রেস হয়ে নাও,জামা প্যান্ট বার করে দিচ্ছি”।
পিউয়ের ঘর থেকে তখন পিউয়ের গলা পাওয়া যাচ্ছে বন্ধুদের সাথে পূজোর প্যানিং নিয়ে কথা চলছে।

Saturday, 22 October 2016

রাধা

 

““বাঁচাও”” চিৎকার টা শুনে আমি থমকে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আর ঠিক তখনই সামনে এসে হুমরি খেয়ে পরলো  মোরের মাথায় ধুপকাঠি বিক্রী করা মেয়টি। আমি প্রথমে চমকে উঠেছিলাম। পরক্ষণেই মনে হলো এখান থেকে মেয়েটিকে সড়ানো দরকার। একটা অটো ডেকে উঠে পরলাম দুজনে। অটোতে যেতে যা শুনলাম তাতে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায় আরকি! মেয়েটির নাম রাধা। এসেছে উত্তরপ্রদেশ থেকে। বাড়ীতে তিন ভাই বোন,মা আর পঙ্গু বাবা। একমাস আগে ওদের গ্রামের একটি ছেলে ,যে এখানে কাজ করে ,তার সাথে কোলকাতা আসে। কিন্তু রাধা জানতো না যে ছেলেটি এখানকার কাজ আসলে চুরি করা।হাওড়াতে নামার সাথে সাথে ছেলেটিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তিন বছরেরে জন্য সে এখন শ্রীঘরে। ছেলেটির এই অবস্থা হওয়াতে রাধা মুশকিলে  পরে গেল। ওর কাছে ফিরে যাবারও পয়সা ছিলনা। দুদিন শুধু রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছে। তারপর একজন ধুপকাঠির হোলসেলার ওকে এইকাজ দেয়। প্রতি প্যাকেটে ৫০পয়সা কমিশন। ভালোই চলছিল। কিন্তু গত চারদিন ধরে তিনটি ছেলে ওকে উতক্ত করছে। আজ তো ওকে জোর করে ট্যাক্সিতে তুলছিল, ও কোনও রকমে পালিয়ে বেঁচেছে। 

কথা শেষকরে হুমরি খেয়ে আমার পায়ের ওপর পড়লো মেয়েটা, “দিদি গো আমায় বাঁচাও। আমাকে যেকোনও একটা কাজ দাও। আমি তোমার ঘরের সব কাজ করে দেব।” আমি ওকে আশ্বস্ত করলাম। ওরয়ে গেল আমার বাড়ীতে। আমার ঠিকা কাজের লোক ছিল। বহুদিন ধরে একটা রান্নার লোক খুঁজছিলাম। রান্নার হাতটা বেশ। আমাদের কিছু রান্নাও ওকে শিখিয়ে নিলাম। ও আসাতে আমার বুটিকের কাজেও আমি বেশ মন দিতে পারছিলাম। আমার শ্বাশুরীও বেশ খুশী। রাধাও খুশী। কদিনেই আমার বাড়ীর লোকের চোখের মনি হয়ে উঠল রাধা। 

একদিন.........

রাতে বাড়ী ফিরেছি। রাধা রাতের খাবার তৈরীতে ব্যস্ত। আমি জল খেতে রান্নাঘরে ঢুকে দেখি আটা মাখার থালাটার ওপর একটা সুন্দর মুর্তি বসানো। ভালো করে দেখে বুঝলাম আটাটাকে মেখে একটা পুতুল তৈরী করে রেখেছে। ব্যাপারটা আমার মজার আর ইন্টারেস্টিং লাগল। পরেরদিন আবার ওর রুটি করার আগে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখি আর একটা অন্য পুতুল বানিয়ে রেখেছে। এই বেশকিছুদিন লক্ষ্য করলাম প্রত্যেকদিনই কিছুনাকিছু ও বানিয়ে রাখে। ওকে জিগ্গেস করে জানলাম ওর বাবা মাটির পুতুল বানাতেন। সেখান থেকেই ও শিখেছিল। আমি জিগ্গেস করলাম,“তোকে মাটি এনেদিলে তুই পুতুল তৈরী করতে পারবি?”। রাধা এতই অবাক হয়ে গেল যে ওর মুখটা হা হয়ে গেল। কি্তু ওর পরের প্রশ্নে আমার হা হবার পালা। ওবলল,“আমায় তাড়িয়ে দেবে নাতো!”

এরপর একটা বছর হুড়হুড় করে কেটে গেল। এগ্জিবিশন আর এগ্জিবিশন। রাধার মুর্তি পুতুল ফুলদানি বিদেশে যাচ্ছে। নিঃসহায় মহিলাদের ট্রেনিং দেয় ও। অনেক মানুষকে সাহায্য করে। আজ ওর অফিসে ওর অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে পুরোনো কথাগুলো এই ভাবেই মনে পরে গেল।

হঠাৎ  সেদিন


আমি সাউথ সিটির ওপরের করিডোরে দাঁড়িয়েছিলাম। প্রথমেই ঢুকলো স্বাগতা। স্বাগতা এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত। আমি ব্যাগে হাত দিতে যাব ফোনটা বার করার জন্য ঠিক তখনই নীলাঞ্জন আর শৈবাল এক সাথেই ঢুকলো। আমি মজা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। ওরা দুজনেই একসাথে স্বাগতাকে ডেকে উঠলো। নীল ফোন বার করছে, আমিও ফোনটা বার করে হাতে নিলাম। সাথেসাথে ফোনটা বেজে উঠলো, “ওপরের রেস্ট্রুরেন্টে চলে আয়। আমি ওয়েট করছি”

স্কুলের চার বন্ধু ফেসবুকের কল্যানে ৪২বছর বয়সে আবার নতুনকরে বন্ধু হয়েছি। আমি,স্বাগতা আর শৈবালের দেখা করাটা কোনও ব্যাপার ছিলনা। চিন্তা ছিল নীলকে নিয়ে। ও থাকে ইউকে। আসবো বললেই আসা যায়না। কিন্তু সে অসাধ্য সাধনও হল,নীল এল। শৈবালকে দেখেই নীলের চোয়াল শক্ত হয়েগিয়েছিল। শৈবালকে ডাকতে বারন করেছিল নীল কিন্তু আমি না ডেকে পারিনি। আমার মনে হয়েছিল শৈবালের পরিবর্তনটা নীল নিজের চোখে দেখুক। শৈবালের পাশে আজ নীলেরই দাঁড়ানো উচিত। শৈবাল আজ সবচেয়ে একা। শৈবালও বোধহয় তাই চাইছিল। শৈবাল নিজে বসে আর একটাচেয়ার নীলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,“বস”। নীল ঘুরে আমার পাশের চেয়ারে এসে বসলো। কেউই কোনও কথা বলছেনা সকলের মনেই একে অন্যের প্রতি বহুবছর আগের বিদ্বেষ যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। আমি শৈবালকে জিগ্গেস করলাম “তোর শরীরের অবস্থা তো খুব খারাপ। রোগা হয়ে গেছিস, চোখের তলায় তো কালিও পরেছে!ডাক্তার কি বলল,রিপোর্টগুলো করিয়েছিস?”। আমার কথা শুনে নীল আর স্বাগতা মাথা নীচু করে থাকা শৈবালের দিকে তাকালো। ওদের ভাবখানা এই যে ‘যাক কেউ একজন কথা তো শুরু করলো’। “রিপোর্ট পজেটিভ” শৈবাল মুখ না তুলেই উত্তর দিল। সাথেসাথেই নীল আর স্বাগতার মুখে একরাশ বিষ্ময় মুখ দিয়ে সমবেত হয়ে বেরোলো, “মানে কী হয়েছে তোর”। দুজনেই অপার বিষ্ময়ে আমার দিকে একবার,একবার শৈবালের দিকে তাকালো। হ্যাঁ আমি জানতাম,বলিনি, চেয়েছিলাম শৈবাল নিজেই বলুক। 

“আমি এইচ-আই-ভি পজেটিভ”। ধারেকাছে  কোথাও বিকট জোরে বাজ পরলো। ক্ষনিকের জন্য গোটা সাউথসিটি মলটাই যেন থমকে গেল। কিন্তু আমাদের মধ্যে যে বাজটা পরলো তাতে আমাদের স্বাভাবিক হবার জন্য বোধহয় শৈবালের পরবর্তী কথাগুলোই দরকার ছিল। “মাসছয়েক আগে একটা কার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। প্রচুর ব্লাড লেগেছিল। তার মধ্যেই আমার মৃত্যুর পরোয়ানা ছিল”। শৈবালের কথা শেষ হতেই স্বাগতা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। নীল যেন কঁকিয়ে উঠলো,“এ তুই কি বলছিস!” নীল চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো ছোটবেলার প্রানের বন্ধুকে, “আমায় ক্ষমা করে দে।আমি বুঝিনি কেন লালি আজকে এখানে আসার জন্য দিব্যি দিয়েছিল”। শৈবাল চোখ মুছে হেসে বলল,“তুই আবার কবে থেকে দিব্যি মানতে শুরু করলি”। নীল চোখ মুছতে মুছতে বলল,“এখন আমার সব মানতে ইচ্ছা করে রে।হয়তো স্বাভাবিকতা টা মানলে আজ আর এই কষ্টটা পেতামনা”। 

শৈবাল স্বাগতার মাথায় হাত বোলায়। “তুই আগে কেন বলিস নি!” অনুযোগ করে স্বাগতা। “আগে জানলে কি করতি,  আমার ভালোবাসা অ্যাকসেপ্ট করে নিতি?” শৈবালের কথায় চুপ করে যায় স্বাগতা। হঠাৎ  ধীর গলায় বলে ওঠে “হয়তো নিতাম!”।  শৈবাল স্কুল থেকে স্বাগতা ভালোবাসতো কিন্তু স্বাগতা শৈবালকে এড়িয়ে চলতো। শৈবাল কোনদিনও মুখফুটে স্বাগতাকে বলেনি যে ও স্বাগতাকে ভালোবাসতো কিনতু আমরা সক্কলে একথা জানতাম। স্বাগতার কথায় আমরা তিনজনেই চমকে উঠলাম। আমি প্রায় চিৎকার করেই বললাম “তুই ম্যারেড ভুলে গেলি নাকি”। ও খুব শান্ত আর দৃঢ় স্বরে বলল “কিচ্ছু ভুলিনি। কাউকে যদি আমি ভালোবাসি তার মানে কি আমি আমার স্বামীকে চিট্ করছি! আমি যদি শৈবালকে ভালোবাসি, ওর সাথে ফোনে কথা বলি,চ্যাট করি তাহলে কি আমার স্বামীকে চিট্ করা হয়! লালি, আমি তোকেও খুব ভালোবাসি। তার মানে কি আমি আমার স্বামীকে চিট করছি?” নীলের তখনও বিষ্ময় কাটেনি,বলল,“কিন্তু এ কেমন ভালোবাসা!” স্বাগতা যেন এক বিদ্রোহী। একটানে সমস্ত নিয়মকানুন উলোটপালট করে দেবে,বলল,“কেন! ভালোবাসা মানেই কি শরীর ছুঁয়ে থাকতে হবে মন ছুঁয়ে কি থাকা যায়না? ভালোবাসা মানেই কি বিয়ে করে সংসার পাততে হবে? ভালোবাসা একটা অনুভুতি। আমার স্বামী আছে বলে সে অনুভুতি কখনই হবে না এরকম তো কথা কখনই থাকতে পারেনা! নীল,লালি বিবাহিত জেনে কি তোর কি লালিরষপ্রতি ভালোবাসা শেষ হয়ে গেছে নাকি লালি বিবাহিত বলে তোকে এখনও ভালোবাসেনা?” এই কথাটারষজন্য আমরা দুজনেই প্রস্তুত ছিলাম না। নীল বলে উঠলো “বাজে কথা রাখ”। স্বাগতা হেসে বলল,“ বাজে কথা!  তুই তো দিব্যি-টিব্যি মানিস না তাহলে আজ লালির দিব্যি মেনে এলি কেন? আর লালিই বা কিসের জোরে বলল ‘নীল আসবেই’,যেখানে আমরা সবাই জানি তোর সাথে শৈবালের মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিল!”

আমরা উঠে পরলাম।  আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছিল। শৈবালের হারিয়ে যাওয়া সবকিছু  আমি ওর জীবনের শেষ সময়ে ফিরিয়ে দিতে পেরেছি। আমাদের জীবনে হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা বন্ধুত্ব ফিরে এল কিনা জানি না কিন্তু শৈবালকে দিতে পেরে আমরা সকলেই অনাবিল আনন্দের অধিকারী হলাম। 

দেখা


খুব আশ্চর্যজনক ভাবে  একটা মলে দেখা হয়ে গেল তুষারের সাথে। আমি মেয়েকে ওর বন্ধুর বাড়ীতে নামিয়ে দিয়ে লেকমলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ  পরিচিত একটা ডাক ‘ওই’ শুনে পিছন ঘুরে দেখি ও। ও আমাকে নাম ধরে ডাকতো না।  ঐ ‘ওই’ বলেই ডাকতো। ওর সাথে আমিও অবাক হলাম যে এখনও ডাকটা ভুলিনি। আমার থেকে ৯বছরের ছোট ছিল দেখে মনে হচ্ছে আমার থেকে ৯বছরের বড়। চুল পেকে গেছে। চেহারাটাও সামান্য ভারী হয়েছে। কিন্তু চোখের সেই চাউনি এখনও আগের মতই। আমি বললাম, “আমি বুঝতে পারছি না আমার কিভাবে রিআ্যাক্ট করা উচিত”। কারণ শেষের দিকে সম্পর্কটা খুব তিক্ত হয়েগিয়েছিল।আমি ওকে বুঝিয়েছিলাম,আমি বিবাহিত। আমার সাথে সম্পর্ক রাখলে ওর কষ্ট শুধুই বাড়বে। ওজীবনে থিতু হতে পারবেনা।  ও আগের মতই হাহা করে হেসে বলল,“তুই এখনও আগের মত পাগলীই আছিস! তুই যেমন ইচ্ছা বিহেব কর আমি মাথা পেতে নেব”।খুব খারাপ ব্যবহার করে আমাকে মানষিক ভাবে পুরোপুরি বিপর্যস্ত করে ও চলে গিয়েছিল। হয়ত আমার প্রতিশোধ নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু পারিনি! ও-ও কোলকাতা ছেড়ে,কোলকাতার সব কনটাক্টস্ ছেড়ে চলে গিয়েছিল গুঁরগাও।   শুনলাম ও মেট্রো স্টেশন থেকে আমায় ফলো করছে। বললাম ,“জানিস কোনও মহিলাকে ফলো করা অনৈতিক!” ও আবার সেইরকম করেই হাসলো। আমরা ওপরের রেস্ট্রোরেন্টটায় গিয়ে বসলাম। জিগ্গেস করলাম বউ মেয়ের কথা। চকিতে গম্ভীর হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমার বিয়ে করাটাই ঠিক হয়নি জানিস। তোর ওপর অভিমান করে তড়িঘড়ি বিয়েটা করেছিলাম। ভেবেছিলাম তোকে দেখিয়ে দেবো তোকে ছাড়াও আমি সুখী হতে পারি”। তুষার থামলো। আমি ভয়ে ভয়ে  ওর নীচু করে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, “পেরেছিস সুখী হতে?”। হট্ করে মুখটা তুলল। মুখে সেই স্বভাবসিদ্ধ স্মিত হাসি কিন্তু চোখ ছলছলে,“সুখী হলে কি আজ আমি এখানে আসতাম? বউকে আপ্রাণ চেষ্টা করি ভালো রাখতে। কিন্তু মেয়েতো,ঠিক বুঝে যায়,আমি অভিনয় করছি। ঠিক যেভাবে তুই আমার সবকিছু বুঝে যেতি।”

এইভাবে অনেক কথা হল। যাবার সময় বল্লাম,“আমি ভেবেছিলাম তুই আমায় ভুলে গেছিস!” ও অদ্ভুত ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,“একবার যে তোর সাথে মিশেছে সে তোকে ভালো নাবেসে,ভুলে থাকতে পারবেনা রে বোকা। তুই নিজেই তোর তুলনা”। লিফটে উঠে আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল। তারপর বলল,“আমায় ক্ষমা করে দিস আমি তোকে ভুলতে পারলাম না বলে”।  লিফটের দরজাটা খুলে গেল সাথসাথে। আর ও বেরিয়ে,“চলিরে” বলে কোথায় হারিয়ে গেল।  আমিও আর খুঁজলাম না। বোধহয় ও হারিয়ে যাওয়াই দুজনের পক্ষে ভালো।

মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ

মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ
এক

২৮শে ডিসেম্বর ২০১৫ রাজা মানে আমার পতি-পরমেশ্বর এবং তার ছোটবেলাকার বন্ধু  অরিঞ্জয় অনেক কষ্টে কদিনের ছুটি ম্যানেজ করে পোটলা পাটলি আর বউ  বাচ্চা বগলদাবা করে বেড়িয়ে পড়লো মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে।  ডিসেম্বর হলে হবে কি মোটেই ঠান্ডা নেই।  কিন্তু রাজাকে কে বোঝায়! ঠান্ডা লেগে যাবু এই ভয়ে  আমার জন্য একটা জাম্বুবানের মত সোয়েটার  নিয়ে এসেছে।  যেটা পরে আমার মনে হচ্ছিল মহাকাশ যাত্রী। ছ’জনে তো পৌছলাম কোলকাতা স্টেশন। নেমে ইস্তক রাজা এমাথা ওমাথা দৌড়ে যাচ্ছে কাধে একটা ভারীব্যাগ নিয়ে। শেষে আমি সুতপা মানে অরিঞ্জয়দার বউকে জিঞ্জেস করলাম“হোলোটা কি?”।  সুতপা বলল রাজা নাকি চা খুজছে। কিনতু দৌড়াদৌড়িই সার। চা পাওয়া গেলনা শেষে ৩০টাকা করে মূল্যবান কিছু কফির মত দেখতে একটা তরল পানকরে ট্রেনে উঠলাম। আমি আমাদের তিনজন মানে রাজা বাবুই আর আমার জন্য চিকেন চাউ করে নিয়েছিলাম। সুতপা বলেছিল অরিঞ্জয়দা আর সবুজ মানে ওদের ছেলে ঠান্ডা চাউ খাবেনা। তাই সুতপা মুড়ি মাখার সরঞ্জাম নিয়েনিয়েছিল। 

ট্রেন চলতে আরম্ভ করেছে। দুদিন ধরে মোবাইল  বোঝাই করেছি হিন্দী গানে। কোলকাতায় থাকলে গান শোনার সময় পাইনা ট্রেনে যেতে শুনবই। মাঝে সুতপা টুকটাক কথা বলছে তার উত্তর দিচ্ছি। বাবুই সবুজের সাথে ইংলিশ ফিল্মের স্টোরি লাইন নিয়ে আলোচনা করে চলেছে। রাজা আর অরিঞ্জয়দা নানান বিষয় নিয়ে আড্ডা দিয়ে চলেছে।  আমি মনে মনে ভাবছি কখন সুতপা কেকটা বার করবে। অসাধারণ বানায় সুতপা কেকটা। 
অবশেষে আমরা লালবাগ স্টেশন নামলাম। আমার এক ভাইসম বন্ধু আছেন তন্ময় ভট্টাচার্য্য যিনি প্রচুর ট্যুর পরিকল্পনা করেন। আসবার আগে ওনার কাছ থেকেই আইডিয়া নিয়েছিলাম যে লালবাগে থাকাটাই স্রেয়। রাজা তাই লালবাগে ‘হোটেল ইন্দ্রজিত’-এ দুটি ঘর বুক করেছিলাম। তাতে আবার ছোট দুটি বারান্দাও ছিল।

এটা শুধুমাত্র   একটি ভ্রমণকাহিনী নয়।  তাই পাঠকের বোঝার সুবিধার জন্য আমি অতীতের কটা কথাবলছি।  তবে পাঠক কে আমি এটাও বলবো যে এখানে আমি যা লিখছি তা নিছক মনরঞ্জনের জন্য নয়। এটা একশ’ শতাংশ সত্যি কথা।
আমি যখন কলেজে পড়ি তখন আমার এক বানধবীর কাকা যিনি তন্ত্রসাধনা করতেন তিনি বলেছিলেন আমি নাকি একটি বিশেষ ক্ষমতার অধিকারি যার সাহায্যে আমি আত্মার সাথে অথবা আত্মা আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারবে। উনি আমায় সাবধান করে বলেছিলেন কখনও যদি আমার গা-ছমছম করে এবং তার সাথে মাথা ঝিমঝিম করে আর বমিভাব হয় তখন যেন আমি ভয় না পেয়ে কাউকে ছুঁয়ে বসি। আমি কিনতু এই কথাগুলো কোনও গুরুত্ব দেইনি।

যাইহোক লালবাগে নেমে মনে হল বেশ ভালোই ক্ষিদে পেয়েছে। আমরা প্লাটফর্ম থেকে বেড়িয়ে স্টেশনের সামনে এসে দাঁড়ালাম। কোনদিকে যাব বুঝতে পারছিনা।  কিনতু আমার মন বলছে এবং একপ্রকার জোর করৈই বলছে আমাদের ডানদিকে যেতে হবে। ততক্ষণে রাজা ফোন করে জেনে নিয়েছে য আমাদের বাঁদিকে কয়েক পা গেলেই হোটেল। আমরা যখন বাঁদিকে ঘুরলাম তখনও যেন কেউ আমাকে প্রবলভাবে পিছনদিকে মানে ডানদিকে আকর্ষন করতে লাগল। আমি একপ্রকার জোড় করেই রাজার পিছু নিয়ে হোটেলের দিকে এগিয়ে গেলাম।             চলবে

মুর্শিদাবাদ 2

প্লার্টফর্ম থেকে বেরোনোর সাথে ট্যাক্সিওলা,টোটোওলা আর টাঙ্গাওলারা ছেঁকে ধরেছিল। অরিঞ্জয়দা ভালো দরদাম করতে পারে বলে রাজা আর ঐদিকে ঘেসলোইনা। আমরা যখনই বেড়াতে যাই হোটেলের ব্যাপারটা রাজাই দেখে। ঘর ধোয়ানো,দরজার লক্ ঠিক আছে কিনা দেখা,বাথরুমের পুরো ব্যবস্থা  ঠিক আছে কিনা — এসব দেখার দায়িত্বে রাজা-ই থাকে।  রাজা তাই হনহন করে হোটেলের দিকে হাঁটা শুরু করলো। আমরা পিছু নিলাম। সর্বশেষে অরিঞ্জয়দা আর তার পিছনে দরদাম করতে করতে চলেছে এক টোটোওলা। হোটেলের ঘরদোর পরিস্কার হওয়ার সাথে সাথে আমি আর সুতপা, বাবুই আর সবুজকে নিয়ে ঢুকে গেলাম স্নান করে পরিস্কার হতে। করিডোরে তখন অরিঞ্জয়দা আর রাজা টোটোওলার সাথে দরকষাকষি করে যাচ্ছিল।
হোটেল ইন্দ্রজিৎ’এর বিশাল বড় বড় সব ব্যাপার স্যাপার। নিচে বার কাম রেস্ট্রুরেন্ট আর ওপরে লজিং। মেনুকার্ডে সব থেকে সস্তা ছিল স্যালাড —৮০টাকা। আমরা আর সাহস দেখাইনি। সামনেই একটা খাবার হোটেল ছিল সেখানে ডাল আলুভাজা আর মাছের ঝোল দিয়ে রোজকার থেকে বেশী ভাত খেয়ে ফেললাম। সঙ্গে উপরি ছিল পোস্তর বরা। তার জন্য অবশ্য অরিঞ্জয়দাকে ধন্যবাদ দিতে হয় কারন উনি দাঁড়িয়ে থেকে বরাগুলো করিয়েছিলেন। খাওয়া যখন মাঝপথে,মনে পরিকল্পনা করছি কম্বল চাপা দিয়ে ঘুমাব, ঠিক তখনই অরিঞ্জয়দা বললেন, “বর্ণালী জলদি খাও গাড়ি এসে গেছে। তাড়াতাড়ি বেরোবো”

খান দশেক পাস-পাস’এর প্যাকেট কিনে আর খাবার জল নিয়ে উঠলাম টোটোতে। যারা জানেনা তাদের জন্য বলি টোটো হল অটোর বড় ভাই,চলে ব্যাটারীতে। মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ কেমন হবে জানিনা কিনতু টোটোতে চেপে যেতে বেশ লাগছিল। বেশ গরম লাগছিল তাই আমি জাম্বুবানটা না নিয়ে একটা হালকা জ্যাকেট আর শাল নিয়েনিলাম।

এদিক ওদিক উবর-খবর পেরিয়ে ঠিক পাঁচটা বাজতে পাঁচমিনিট বাকি আমরা পৌছলাম বহরমপুর, কসিমবাজার রাজবাড়ী। এই রাজবাড়ীটি কিন্তু আসল রাজবাড়ী নয়। আসলটির জীর্ণদশার জন্য পরে এটি তৈরী করা হয়।  তাই এটিকে ‘ছোটরাজবাড়ী’ বলা হয়।  বড়রাজবাড়ীটিতে এখন পাটর গুদাম। এই খবরটি আবার সুতপা একজন স্থানিয় মহিলাকে জিঞ্জেস করে জেনেছিল। বিশাল এলাকার উপর দালান বাড়ি। ধপধপে সাদা, ছাদের ওপরে একটা বিশাল ঘড়ি, সাদা পরী, বিশাল ঝরনা, সব মিলিয়ে যেন পুরোনো আমলের ইংলিশ প্যাটার্নের কোন বাড়ী। ভিতরে রয়েছে একটা ছোট মিউজিয়ম। যেখানে মূল্যবান পেইটিং, ঝারবাতি, আসবাব ও একটি পালকি ছিল। এছারা একটি দূর্গাদালান এবং একটি লক্ষীনারায়ণ মন্দির রয়েছে। সেখানে এখনও দূর্গাপূজা ধুমধাম করে হয়। দূর্গাদালানে অনেক সুন্দর সুন্দর ঝাড়বাতি ঝুলছিল যেগুলো পলিথিনে মোরা ছিল। আর ছিল পেল্লাই তামার ঘট তার ওপর পেল্লাই তামার আমপল্লব আর তামার ডাব। আমরা ওখান থেকে বেরিয়ে যখন গেটের দিকে যাচ্ছি ওখানকার লোক বলল আমাদের ঐ চত্বরের মধ্যে থাকা সুগার এন্ড স্পাইস- এর দোকঅনের ভিতর দিয়ে যেতে হবে। রাজার প্রশ্নের উত্তরে ওরা বলল সুগার এন্ড স্পাইস কোম্পানিটাই কাশিমবাজার রাজপরিবারের।

যাইহোক সন্ধ্যে নাগাদ আমরা পৌছলাম পাতালেশ্বর শিবের মন্দিরে। বড়বড় গাছের মাঝখান দিয়ে কয়েক পা হেঁটে মন্দির চত্বরে ঢুকলাম। পাতালেশ্বর নামটা অদ্ভূত । মন্দিরের মধ্যে শিবলিঙ্গের অবস্থান চার-পাঁচ ধাপ সিড়ি নিচে। মন্দিরটা একটা বিশাল বড় লেকের ধারে। বাংলায় যাকে বলে সরোবর। নাম কাটিগঙ্গা।

খুব অদ্ভুত ভাবে এখানে আমার ফোনটা জবাব দিল। আমি আমার ফোন কখনও সুইচ অফ করিনা। এই নিয়ে রাজার সাথে আমার প্রচুর তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। রাজা ঘুমানোর সময় ফোন অফ করে শুতে বলে। কিন্ত এটা আমার কুসংস্কার হোক বা যাইহোক, ফোন বন্ধ হলে একটা অঘটন ঘটে। হয়ত সেই কারণেই হোক বা অন্য কোনো কারনে ফোন অফ হওয়ার সাথে সাথে আমার শিরদাঁড়া দিয়ে যেন একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। তবে কি কোনও অঘটন ঘটতে চলেছে!! আমার ব্যবহারে রাজা একটু অবাক হল কারন আমি একদম গুম মেরে গিয়েছিলাম। রাজার একটাই চিন্তা আমার মাথা ধরলো কিনা। উদ্বিগ্ন হয়ে জিঞ্জেস করেই ফেলল “কি হয়েছে তোমার ”। আমি ফোনটা তুলে দেখালাম। প্রথমে ও কোনও গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু যেই মুহূর্তে ও শুনলো যে বেরোবার সময় আমার যা চার্জ ছিলো তাতে এত তাড়াতাড়ি অফ হবার কথা নয় তখন ও-ও অবাক হল। কোনও জিনিস নিয়ে বেশীক্ষণ ভাবা ওর ধাতে সয়না তাই ও ভুলেও গেল। বেশ সন্ধ্যে হয়ে গেছে আমার কেমন গাছমছমে লাগছিল। রাজা বেড়িয়েই আবার চা খাবার জন্য বায়না করলো। আমার কিছু ভাল লাগছিল না হোটেলে ফেরার জন্য মনটা কেমন করছিল। ওরা চা খাবার কথা বলতেই টোটো ড্রাইভারের মুখে যেন একটা ছায়া দেখলাম,সেটা কি আমার ভুল!!

টোটো আমাদের নিয়ে যখন পিচ রাস্তায়  উঠল তখন রিতীমত রাত। আর বেজায় ঠান্ডা। আমার মন তখন আমার জাম্মুবানটাকে খুব মিস করছিলাম।  ব্যাগ থেকে শালটা বার করে বাবুই কে দিলাম মাথা ঢাকার জন্য আর আমি জ্যকেটের হুডটা তুলে নিলাম। চারিদিকে নিকশ কালো অন্ধকার। টোটো ক্ষমতার বাইরে ভার নিয়েছে বলে বারবার ব্যটারীর কানেকসন কেটে যাচ্ছিল। ড্রাইভার হেডলাইট অফ করে চালাতে লাগল। সবাই চুপচাপ। সবাই হয়তো মনে মনে ভাবছিল, ড্রাইভারের কথা শুনলেই হত। অতো বেলাতে এদিকে না এলেই হত! অরিঞ্জয়দা যাবার সময় মাঝে মাঝেই ড্রাইভারের হাত থেকে নিয়ে টোটো চালাচ্ছিলেন। কীন্তু এখন বোধহয় ওনারও হোটেলে ফেরার তাড়া ছিল। সবাই নিশ্বাস  বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছি। অন্ধকারের মধ্যে একটা কবরখানা পেরোলাম। মাঝে মাঝে পুরোনো বাড়ীর ধ্বংসাবশেষ পেরোচ্ছিলাম।

হঠাৎই দুরে আলোর রেখা দেখতে পাওয়া গেল। ড্রাইভার অস্ফুটে বলল “মোতিঝিল”।  ওঃ তাহলে তো প্রায় এসে গেছি! সবাই নড়েচড়ে বসল। প্রথম মুখ খুলল সবুজ— “বাবা চিপস খাব” সাথে সাথে বাবুই পোঁ ধরলো। আমরা চিপস চিড়ে ভাজা বাদামভাজা কিনে টোটোতে চাপলাম।
পাতালেশ্বরের ওখান থেকেই আমার মাথা ঝিমঝিম করছিল,বমি-বমি ভাব আর মাথাটাও ভীষণ ভাবে ওলোট-পালোট করছিল। টোটো থেকে নেমে আমি রিতীমত টলছি দেখেই বোধহয় রাজা বলল “চা খেয়ে যাও”। হোটেলে ঢুকে সবার আগে ফোনটা চার্জেবসিয়ে অন করতেই দেখি ব্যাটারী  ৬০ পার্সেন্ট! অদভুত তালে ফোনটা কিছুতেই  অন হলনা কেন! ফটো তুলতেই পারলাম না।!

মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ ৩

ফ্রেশ হয়ে বসার পর মনে হল বেশ খিদে পেয়েছে। তিনজনে মিলে চিড়েভাজার সদগতি করলাম। সুতপা বাকী কেক সবুজের হাত দিয়ে পাঠাল আমাদের ঘরে। বাবুই আর সবুজ দাবা খেলতে বসল আর আমি ওদের খেলা দেখতে কখন যেন ঘুমিয়ে পরেছিলাম। ঘুম ভাঙ্গল রাজার ডাকে,— “ওঠো খেতে যাবে চল”। তাকিয়ে দেখি বাবুই তৃতীয় রাউন্ড সাজুগুজু করছে। খেতে যাবে,এত রাতে কে দেখবে ওকে! তবু ঠোটে লাল রঙ ঘসছে। রাজা বলল,—“খাবার সময়ও লিপস্টিক লাগাতে লাগে!”
বাবুই গম্ভীর হয়ে বলল,—“এটা লিপস্টিক  নয়,লিপবাম। ঠোটফেটে যাবে তাই লাগাই”। ঠিক সেই সময় পাশের জঙ্গল থেকে একদল শেয়াল ডেকে উঠল যেন বাবুইয়ের কথারই সম্মতি জানালো। আমি আর বাবুই দুজনে দুজনের দিকে তাকালাম। দুজনেই বুঝলাম দুজনই ভয় পেয়েছি। আমার আর জামাকাপড় বদলাতে ইচ্ছা করছিলনা। কটসুলের হাউসকোটের ওপর জাম্মুবানটা চাপিয়ে বেড়লাম।

আমাদের হোটেলটার ধারেকাছে কোনও বসতি সেরম নেই। হোটেলের ডানদিকে  একটা ফাকা জমি। তার পাশে একটা পরিতক্ত কবরখানা। আর বাদিকে যেদিকে  চোখ যায় ফাকা জমি পরে রয়েছে দূরে রেললাইনের  আলো দেখা যায়। আমরা যেখানে খেতে গেলাম সেটা ‘ঠাকুরের হোটেল’। আমার একটু খাবার ব্যাপারে নিটিস-পিটিস আছে। আমি এক তরকারী দিয়েও খেতে পারি যদি সেটা খেতে ভাল হয়। ঠাকুরের রান্না ছিল অসাধারণ ,যেকারণে আমার অসুস্থতা সত্ত্বেত্ত নীচে নেমেছিলাম খেতে। আমাদের ঠাকুর খুব খাতির করছিল। অরিঞ্জয়দা ছিলেন খাবার ডিপার্টমেন্টে। দুপুরে খেয়ে বেরোনোর সময়ই নাকি উনি বলে গিয়েছিলেন মাংস রান্না করতে। এখন গরম নরম রুটি একটুকরো ছিড়ে মাংসের ঝোলে ডুবিয়ে মুখে দিতেই আরামে চোখ বুজে গেল। “রান্না-বান্না কেমন দাদা” কথাটা শুনে চোখ খুললাম। রাজাকে একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক জিগ্গেস করছেন। কথায় কথায় উনি বললেন কোলকাতা থেকেই এসেছেন। আমি দেখেছি আমাদের হোটেলেই উঠেছে একগাদা লোক নিয়ে, কাচ্চা-বাচ্চা চ্যা-ভ্যা করছিল। আমি খাওয়া শেষ করে সকলকে গুডনাইট বলে ঘরে ফিরে এলাম। কালকের দিনটা যাতে গুবলেট না হয় তার জন্য একটা ক্রোসিন খেয়ে শুয়ে পরলাম।

রাত তখন ক’টা হবে জানিনা ঘুম ভেঙ্গে গেল শারিরীক অস্বস্তিতে। গা বমি বমি করছে মাথাও ঝিমঝিম করছে। ভাবলাম একসাথে তিনজনশোবার অভ্যেস নেই তাই হয়তো অস্বস্তি হচ্ছে। মাথা ঝিমঝিম করছিল। ভাবলাম হয়তো সাফোকেশন হয়েছে বারান্দায় দাঁড়ালে ঠিক হয়ে যাবে। ঠিচ সেই সময় শেয়ালগুলো ডেকে উঠলো,মোবাইলে দেখলাম তিনটে বাজতে দশ। বারান্দার দরজাটা খুলে নিঃশব্দে এসে বাইরে দাঁড়ালাম। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। একহাত দূরের মানুষ দেখা যায়না। কিন্তু শেয়ালের চোখগুলো সটান আমার দিকে তাক করা।অত নিকশ কালো অন্ধকারের মধ্যেও ওরা কিকরে আমায় দেখতে পেল জানিনা হঠাৎ শেয়ালগুলো আবার ডেকে উঠল। আমি চমকে উঠে দেখলাম একটা সাদা ধোঁয়ার কুন্ডলী একবার ভেসে ডানদিকে যাচ্ছে একবার বাঁদিক। আমি খুঁজতে থাকি ধোঁয়ার উৎসটা কোথায়। আর ঠিক তখনই দমকা কনকনে হাওয়ায় মেরুদণ্ড সুদ্ধ কেঁপে উঠলো, কুন্ডলীটা একই ভাবে এদিক ওদিক করে যেতে লাগলো—হাওয়ায় কিনতু বিলীন হলনা! আবার এটাও আশ্চর্য্য যে ঐ নিকশ কাল অন্ধকারে আমি ধোঁয়া দেখছি কিকরে। শারিরীক অস্বস্তিটা আরও বাড়তে লাগল। আমি দরজা বন্ধ করে ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ধোয়াটা কিসের ছিল—এই ভাবনা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। আমরা যেই হোটেলে খেতাম তার উলটোদিকেই দিকেই ছিল কবরখানাটা। হোটেলের মালিকটি রাতে হোটেলেই ঘুমাতো। শেয়ালের অস্তিত্বের কথা ও স্বীকার করলেও ‘মানব-অস্তিত্ব পুরোপুরি উড়িয়েদিল। কবরখানায় এত জঙ্গল যে গন্ডা দশেক অ্যানকোন্ডা থাকলেও আশ্চর্যজনক নয়! কেউযে ওখানে ঢুকবে তার তো প্রাণের ভয় আছে! য আমি আর রাতের মায়াবী ধোঁয়ার কথা আর কাউকে না বলে চেপে গেলাম।

যাইহোক ভোরের দিকে টের পেলাম আমার ভালই জ্বর এসেছে। কাউকে কিছু না বলে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকলাম।

মুর্শিদাবাদ ৪

নাহ্ শুয়ে থাকার জো নেই। রাজা কাল শোবার সময় বলেছিল ড্রাইভার বলেছে সাড়ে আটটার মধ্যে তৈরী হয়ে যেতে। আজকেই আমরা মেজর পার্টটা দেখবো। তাই সাতটা কুড়ি বাজলেই যেন রিসেপসনে ফোন করে দুটোরুমে দুটো করে চা বলে দেই আর চা দিতে এলে যেন স্নানের গরম জলটা বলেদেই।
বলে তো দিলাম কিন্তু পৌনে আটটা বাজে চা আর আসেনা! ইতি মধ্যে আওয়াজ পাচ্ছি ঐরুমেও কেউ উঠেছে। আমি ভুতের মত অন্ধকার ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আলো জ্বাললে ঘুম ভেঙ্গে যাবে। এই সময় কম্বলের মধ্য থেকে আওয়াজ এল,—“চা বলেছো”। কথা শেষ হতেই দরজায় টোকা— চা এসে গেছে। কিনতু একি চা! প্রথমতঃ আমি দুধ চা খাই না, তবু খেতাম যদি সেটা চায়ের মত হত। আমার বেজার মুখ দেখে রাজা বলল এখন খেয়ে নিতে একটু পরে নীচে গিয়ে সামনের দোকান থেকে চা খাব। আমরা সকালের খাওয়া শেষ করে যখন টোটোতে উঠলাম তখন প্রায় সারে নটা। ড্রাইভার বেশ বিরক্ত।

প্রথমেই গেলাম হাজারদুয়ারি প্যালেস। স্টেশন থেকে বেড়নোর পর আমারমন যে ডানদিকে যেতে চাইছিল। সেই ডানদিকের রাস্তাই আমাদের হাজারদুয়ারি নিয়ে গেল। আমি যতবার পাশ দিয়ে টাঙ্গা যেতে দেখছিলাম ততবার বলছিলাম— আমি টাঙ্গা চড়ব। শেষপর্য্যন্ত না চড়েই কোলকাতা ফিরেছিলাম। যাইহোক গেট পেরিয়ে ভেতরে পা রাখতেই যেন একটা অন্য জগতে এসে পড়লাম। আমাদের ঢুকতে দেখেই একজন গাইড এগিয়ে এলেন। উনি বাইরে থেকে আমাদের বুঝিয়ে দেবেন,ওনাদের ভিতরে যাবার অনুমতি নেই। ওনার কথামত টিকিট  কেটে মোবাইল  ক্যামেরা জমা দিয়ে আমরা প্যালেসের সামনে এসে দাঁড়ালাম। গাইড বলতে শুরু করলেন। গাইডের বলা শেষ হলে আমরা ভিতরে ঢুকলাম।
সদর দরজার দুপাশে বড় বড় দুটো গাড়ি । একটা ঘোড়াচালিত একটা ঊটচালিত। অনেকেরই একটা ভুল ধারনা আছে যে হাজারদুয়ারি তৈরী  করেছিলেন সিরাজদৌল্লা। কিন্তু আসলে হাজারদুয়ারি তৈরী করেছিলেন  নবাব হুমায়ুন জাঁ। এই প্যালেসে নকল ও আসল মিলিয়ে মোট হাজারটি দরজা আছে। সেই কারনেই এই নাম। বিশাল বিশাল ঘর, মোটা মোটা থাম। এ গ্যাল্যারি থেকে ও গ্যাল্যারি কত না ঘুরলাম! দেখলাম যেই কামান বিস্ফোরন হয়ে সিরজদৌল্লার সেনাপতি মীরমদন মারা গিয়েছিলেন,অস্ত্রাগারে মুর্শিদকুলি খাঁ-মীরজাফর-সিরাজের ব্যবহৃত অস্ত্র, বিশাল বড় ঝাড়লন্ঠন— যেটি ব্রিটেনের মহারাণী এলিজাবেথ উপহার দিয়েছিলেন, নবাবীআমলের দামী আসবাব যেগুলি নবাবরা ব্যবহার করেছেন,সম্রাট ঔরঙ্গজেবের প্রিয় কন্যা জেবুন্নিসার ব্যবহৃত হাতির দাঁতের হাওদা(হাতির পিঠে বসার জায়গা), রূপার পালকি-চেয়ার,রূপার ড্রেসিংটেবিল, মূল্যবান বই-এর পান্ডুলিপি আরও কত কি! এমন আয়নাও দেখলাম যেখানে নিজেকে ছাড়া সবাইকে দেখা যায়। পরীক্ষা করার জন্য আমি রাজাকে জড়িয়ে দাঁড়ালাম। তবু আমি রাজাকে দেখতে পেলাম কিনতু আমাকে পেলাম না। আমরা গাইডের বলে দেওয়া প্রতিটা জিনিস মিলিয়ে দেখতে দেখতে যাচ্ছি। হঠাৎ  রাজা বলে উঠল,—“ আরে!সেই দ্বিতীয় বৃহত্তম ঝাড়লন্ঠণটা কোথায় গেল!” আমরা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছি কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত। রাজা তখনও বলে চলেছে,—“এই জন্য বলছিলাম,এটা কেমন হল ভেতরে কোনও গাইড কেন থাকবেনা_ _ _”।  ওর গজগজানি ক্রমশ বাড়ছিল দেখে আমি বল্লাম,—“ঠিক আছে তুমি চিন্তা কোরোনা আমি কোলকাতা ফিরে মুখ্যমন্ত্রী মহাশয়াকে এ বিষয়ে অনুরোধ করবো। উনি নিশ্চই ব্যাপারটা ভেবে দেখবেন।”  আমার ঠাট্টা শুনে সকলেই হেসে ফেলল। ঠিক সেইসময় আমাদের পাশ দিয়ে এক মাঝবয়সি দম্পতি যাচ্ছিলেন। ওনারা আমাদের সঠিক ডিরেকসন দিয়ে দিলেন। একটি ঘরে পুরো রাজদরবারটিই সাজান ছিল।  দেখে আমার সারা শরীর রোমাঞ্চিত  হচ্ছিল এই ভেবে যে এই সবের মধ্যে কত নবাবের হাতের ছোঁয়া রয়েছে যাঁরা এখন ইতিহাস। এখানে না আসলে তো অনেক নবাবের নামও জানা হতনা! আমরা সিরাজকে জানতাম, আলিবর্দী খাঁকে জানতাম, মীরজাফর কেও জানতাম কিনতু নাজমুদৌল্লা, সইফুদৌল্লা, মোবারকদোল্লা, বাবরআলি, আলিজা, ওয়ালাজা, হুমায়ুনজা, ফেরাদুনজা, হাসানআলি, ওয়াসেফআলি, ওয়ারেশআলি — এঁদের নাম কি জানতাম?! এঁরা হলেন নবাব মিরকাশিমের পর থেকে সর্বশেষ নবাব।
আমরা বেড়িয়ে এলাম প্যালেস থেকে। রাজার চা খাবার বিরতি চাই। ঠিক হল জমা দেওয়া জিনিষগুলি নিয়ে তারপর ওই চত্বরের বাকি দ্রষ্টব্য দেখাহবে। আমাকে আর সুতপাকে সিঁড়ির পাশের সিংহটার সামনে দাঁড়াতে বলে এরা চার জন চলে গেল। চারিদিকে লোক গিজগিজ করছে। লোক এটা পিকনিক স্পট বানিয়ে ফেলেছে। চা-কফিওলা ছাড়াও বিভিন্নরকম চাবির রিং কলম নিয়েও ফেরিওলা ঘুরছিল। ঠাটাপোড়া রোদ্দুর,কত লোক যে লোক সিংহের সাথে আমাদের ফটো তুলল তার ঠিক নেই। এদিকে এদের পাত্তা নে। আমার পারদ চড়ছে। আমার পায়চারি দেখে সুতপা মন্ত্রের মত মাথা ঠান্ডা রাখার পরামর্শ দিয়ে চলেছে।

অবশেষে ওরা আসার পর চা খেয়ে মাঠের মাঝখানে  পেল্লায় কামানের সামনে গিয়ে দাড়ালাম। কামানের নাম ‘বাচ্চোবলী’ কামান। কামানটি ভাগীরথীর তীরে মাটি খুঁড়ে পাওয়া গিয়েছিল। পরীক্ষামুলক ভাবে একবার এটিতে বারুদ ভোরে তোপ দাগাও হয়। সেই আওয়াজে আশেপাশের এলাকার যত গর্ভবতী  ছিলেন প্রত্যেকের গর্ভপাত হয়ে যায়। সেই কারনে এই কামানের এইরূপ নামকরন হয় এবং এটিকে সীল করে দেওয়া হয়।

হাজারদুয়ারী প্যালেসের ঠিক উল্টোদিকে  অবস্থিত  ‘ইমামবড়া’। এটি প্রথমে সিরজদৌললা তৈরী করেছিলেন। তখন সেটি ছিল কাঠের। ১৮৪৬ সালে এটি আগুন ধরে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে যায়।  পরের বছর নবাব হুমায়ুন জার পুত্র বর্তমান ইমামবড়াটি তৈরী করেন। মহরমের সময় ছাড়া বাকী সারাবছর এটি বন্ধ থাকে।

মাঠের প্রায় মাঝখানে একটি ছোট মসজিদ আছে যেটি সিরাজদৌল্লা মদিনার মাটি এনে তৈরি করেছিলেন। এটি মদিনা বলেই পরিচিত।  এছাড়া আছে ঘড়িঘর আর আরএকটি মসজিদ। আমরা ওখানে টুকটাক কটা ফটো তুলে ‘জাহানকোষা’ কামানের অভিমুখে রওনা হলাম। প্রত্যেকটা দর্শনীয় স্থানে বাংলায় পরিচিতি লেখা ছিল।  এবার রাজা সবুজ আর বাবুইকে টাস্ক দিল,যে একদম না থমকে পুরো সাইনবোর্ডটা পড়তে পারবে তাকে সেদিন পছনদসই ডিনার খাওয়ানো হবে। বলাবাহুল্য ওরা পারেনি। আমরা তখন ওদের দেখে হেসেছিলাম কিনতু বাঙালী হিসাবে আমদের অকৃতকার্যতাই প্রকাশ পেয়েছিল। আমাদের কাজে অনুপ্রানিত হয়ে উপস্থিত সকল বাঙালী তাদের সন্তানের কৃতিত্ব দেখবার ও দেখাবার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়লেন। কিনতু আমাদের সময় ছিলনা কারণ আমাদের উদর মাঝেমাঝেই জানান দিচ্ছিল এবার আমাদের হোটেল অভিমুখে যাওয়া দরকার। আমরা রওনা দিলাম।

মুর্শিদাবাদ ৫

কোন রকমে গোগ্রাসে  খেয়ে আমরা আবার তৈরী  বেড়োবার জন্য। এবার আমরা গেলাম কাটরা মসজিদ। পথিমধ্যে অরিঞ্জয়দা বারদুয়েক ড্রাইভারের হাত থেকে গাড়ি নিয়ে চালাতে শুরু করেছে। আমাদের টোটো টার গায়ে লেখা ছিল অনন্ত। তাইদেখে সবুজ ড্রাইভারকে ‘অনন্তকাকু’ বলে ডাকতে শুরু করলো। আর অনন্ত কাকুও তার ভাইপো ভাইঝির কান্ড দেখে বেশমজাই পাচ্ছিল তা তার চোখমুখ দেখে বেশবোঝা যাচ্ছিল। আমরা মোটা মুটি গ্রাম এলাকা পেরিয়ে কাটরা মসডিদের সামনে দাঁড়ালাম। না ‘সামনে’ বলা ভুল আসলে এখন যেটা সামনে সেটা কিনতু পিছন। তার কারণটা বলতে গেলে বহু পিছনে যেতে হবে।

বুরহানপুরের দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবার, ঠিকমতো খাওয়া জুটতোনা। দারিদ্রতা জন্য হাজী ইসপাহানী নামে এক বণিকের কাছে ক্রীতদাস হিসাবে ছেলেকে বিক্রী করে দেয় পরিবারের  কর্তা। বণিক তার নাম রাখে ‘মহম্মদ হাদী’। ক্রীতদাস হিসাবে কিনলেও তাকে নিজের ছেলের মত যথাযথ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। কালক্রমে মহম্মদ হাদী ঔরঙ্গজেবের সুনজরে পরে যান এবং বাংলার জায়গিরদার হিসাবে বাংলায় আসেন। বিশাল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করে সম্রাটকে প্রদান করেন এবং নবাব হন। নাম ধারন করেন মুর্শিদকুলি খাঁ। নবাব হয়ে তাঁর শিকরের কথা মনে হয়। নিজের জন্মস্থানে যান। কিন্তু এত বছর মুসলিম জগতে থাকার ফলে তাঁর হিন্দু সমাজ তাকে গ্রহন করেনা। ফলে তিনি হিন্দু বিদ্বেষী হয়ে পরেন এবং যত হিন্দু দেবদেবীর মন্দির আছে ধ্বংস করতে শুরু করেন। কিনতু হঠাৎ তাঁর নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ হয় এবং তিনি প্রায়শ্চিত্তের জন্য বদ্ধপরিকর হন। তিনি তাঁর নিজের সমাধিমন্দির ও তার সংলগ্ন  এই মসজিদ টি তৈরীর ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সেই সঙ্গে এইরূপ ইচ্ছাও প্রকাশ করেন যে এই মসজিদের  প্রবৈশ পথের তলায় যেন তাঁকে সমাধিস্ত করা হয়, যাতে মানুষের পায়ের ধুলায় তাঁর প্রয়শ্চিত্ত হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে সাধারণ মানুষ ও নবাবগন তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাপরবশ হয়ে মসজিদের পিছন ফটকটিই প্রধান ফটক করেন।

এই মসজিদটি তৈরীর দায়িত্বভার ছিল মুর্শিদকুলী খাঁর একান্ত অনুগত ফরাস খাঁর ওপর। এটা নাকি মক্কার সুপ্রসিদ্ধ কাবা মসজিদের  অনুকরণে তৈরী । এর চারদিকে চারটে প্রায় ৭০ফুট উঁচু মিনার ছিল। ভূমিকম্পে দুটি ধ্বংস হয়ে গেছে আর দুটি কোনোমতে বেঁচে আছে। মসজিদের  বাইরের দিকের দেয়ালে বড় বড় চৌকো খোপ কাটা। গাইড বলল ঐ খোপগুলোতে বেলজিয়ান গ্লাস  লাগানো ছিল। উলটোদিকের পাঁচিলের কুলুঙ্গিতে প্রদীপ জ্বালানো হত আর সেই আলো কাচে পড়ে মসজিদ আলোকিত হত। মসজিদের  নীচে প্রায় আধমানুষ সমান ফাকা ছোট ছোট ঘরের মতন সেখানে গুপ্তচরেরা পাহারা দিত। আমরা সিড়িঁ দিয়ে উঠে এলাম এক বিশাল প্রশস্ত জায়গায় যেখানে এক সাথে ১২০০ মানুষ নামাজ করতে পারতেন। মেঝেতে পাতলা ইট সুন্দর করে সাজিয়ে  ১২০০ লোকের আসন করা রয়েছে। গাইড দেখালো মসজিদের    দেয়ালে বড়বড় মোটা মোটা লোহার কড়া লাগানো। ইদ মহরমের সময় বিশাল বড় চাঁদোয়া টাঙ্গান  হত ঐ কড়াতে দড়ি বেঁধে। এবার আমরা আসল মসজিদের  ভেতর ঢুকলাম। পূর্বে পাঁচটি গম্বুজ থাকলেও এখন একটাও নেই। একটা জায়গায় একটুখানি দেয়ালের অপূর্ব কাজ এখনও তখনকার  রাজকীয়তার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গাইড আমাদের চারদিক ঘিরে থাকা ঘরগুলো দেখালো, বলল এখানে সেইসময় কোরান এবং প্রবিত্র গ্রন্থ পঠন- পাঠন হত। আসলে এখানে বিশাল বাজার বসতো। এখন সে জায়গায় নানা রকম ফুলের গাছ লাগানো। এবার আমরা সামনের ফটকের দিকে এগিয়ে গেলাম যেখানে মুর্শিদকুলি খাঁর সমাধি। আমার এই সমাধি দেখতে ভাল লাগেনা বলে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভাল লাগল গাইডের কথা। সে বলল,—“দিদি দেখে আসুন।  সত্যি-মিথ্যা কেউই জানিনা যে আমাদের পায়ের ধুলায় ওনার প্রায়শ্চিত্ত হবে কিনা। কিন্তু যদি হয় তাহলে ওঁনার এই সামান্য ইচ্ছা থেকে বঞ্চিত  করবো কেন বলুন।” ভালো লাগল কথাটা। এগিয়ে গেলাম।  কোনরকম আরম্বর ছাড়াই সিঁড়ির  তলায় চিরঘুমে ঘুমিয়ে আছেন বাংলার প্রথম নবাব। 

ঘোরের মধ্যে বেড়িয়ে এলাম কাটরা মসজিদ থেকে। বেড়িয়েই সামনে ঘোর বাস্তব। কালো একটি মেয়ের পরনে ক্যাটক্যাটে সবুজ আনাড়কলি তাতে সোনালি জরদৌস। মুখ থেকে অজান্তেই বেরিয়ে এল “আজিমুন্নউসা বেগম” ইতিহাসে যিনি কলীজাখাকি নামে কুখ্যাত ।

মুর্শিদাবাদ ৬

কাটরা মসজিদের  সামনে প্রচুর সুন্দর কাঠের ঘর সাজাবার জিনিস নিয়ে বেশ কয়েকজন  স্থানীয় লোক বসেছিল। আমরা একটু উঁকিঝুঁকি মেরে টোটোতে এসে বসলাম। কেনার ইচ্ছা ভীষন থাকলেও সময় একেবারে ছিলনা। কারণ  সন্ধ্যে হতে আর বেশী  বাকি নেই। গাড়ী ছুটলো ‘কাঠগোলা বাগানে’র দিকে।

বাগানে ঢুকতে গেলে টিকিট  কাটতে হয়। এবং অন্য জায়গাগুলোর মত এখানেও ঢোকার আগে গাইড আমাদের পাকরাও করলো। আমি বলেছিলাম গাইডের দরকার নেই। সত্যিই  কোনও দরকার ছিলনা কিনতু অরিঞ্জয়দা কোনও চান্স নিতে চাইলেন না। আমরা গাইডের পিছুপিছু ঢুকলাম। বিশাল আম বাগান পেরিয়ে আমরা কাঠগোলা প্যালেসের সামনে গিয়ে দাড়ালাম। এই বাগান দাড়িয়ে রয়েছে ৩০একর জমির ওপর। শুনে খুব অবাক হলাম যে আসলে এই বাগানে মূল্যবান কালো গোলাপের চাষ হত।  এখন আর তা হয়না।  তার বদলে হয় আম চাষ। এই কাঠগোলার যে প্রতিষ্ঠাতা লক্ষীপত সিং দুগার আর তার ছোটভাই এখানে কাঠের ব্যবসা করতেন। তাই এই বাগানের নাম ছিল কাঠ-গোলাপের বাগান। একটা লাল রঙ করা কয়েক ধাপ সিড়ি নেমে জলের মধ্যে অথচ এটা কোনও পুকুরের ঘাট নয়। শুনলাম আসলে এটা ছিল মাটির নীচে গুপ্ত ঘর।এবং বলা যেতে পারে একটা গুপ্ত প্যাসেজ যেটা গিয়ে উঠেছিল জগৎশেঠের বাড়ি  যেখান দিয়ে হীরবাঈ যাতায়াত করতেন।
বলা যেতে পারে হীরাবাঈ একাই একটা মীথ। হীরা অসামান্যা সুন্দরী ছিলেন। যদিও নবার সিরাজের জন্য তিনি নাচতেন কিন্তু অনেকেই তার প্রতি আসক্ত ছিলেন। 
যাইহোক আমি বুঝলাম না জায়গাটা জলভর্তি হল কিকরে । বাগানের একদিকে একটা উচু বেদীর ওপর মাইকেল এঞ্জেলোর সুন্দর শ্বেতপাথরের মূর্তি রয়েছে। কথিত আছে যে শিল্পী এই মূর্তি তৈরী করেছিলেন তিনি যাতে আর এইরূপ তৈরী  না করতে পারেন তার জন্য কবজি থেকে হাতটি কেটে নেওয়া হয়।
       এখানে একটি স্টেজের মত জায়গা ছিল। সেটাও শ্বেতপাথরের তৈরী। চারদিকে সুন্দর আলোর স্তম্ভ। স্টেজটা নাকি আগে কাচ দিয়ে ঘেরা ছিল। ঐস্টেজেই হীরাবাঈ নাচ পরিবেশন করতেন। সেই সময় তিনি তার একদিনের নাচের জন্য ৩০০০ টাকা পারিশ্রমিক নিতেন।
        বাগানের মাঝে বেশ বড় একতলা একটি বাড়ী দেখলাম।  ওটাছিল রাননাঘর এবং চাকরদের থাকার জায়গা।
        আর একটি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত  বাড়ী দেখলাম।  সেটিছিল ভারতের প্রথম চিড়িয়াখানা।
        একটি বিশাল দিঘি আছে যেখানে প্রচুর মাছ থাকতো। দিঘিটার খুব সুন্দর ঘাট এখনও আছে।
        এবার পরেশনাথের মন্দির আবার জৈন মন্দিরও বলে।  অপূর্ব সুন্দর শিল্পকলা। ১৯৩৩ সালে লক্ষীপত সিং দুগার তাঁর মায়ের ইচ্ছানুসারে এই মন্দিরটি করেন। এইমন্দিরটির ভিতরে দরজার  সোজসুজি একটি মার্কারি বল ঝুলছে যেটা ঐভাবে রাখার উদ্দেশ্য ছিল এই যে,যেকোনও স্থান থেকেই শত্রুপক্ষ আক্রমন করলে যাতে দেখা যায়। বর্তমানে সেটি নষ্ট হয়ে গেছে।
         আমরা কালো গোলাপ পাইনি ঠিকই কিন্তু অনেক সুন্দর সব গোলাপ দেখেছি। ফটোও তুলেছি।
         মূল দালানের একতলাটায় নানারকম কাঠের আসবাব আছে। আমরা আর সেখানে ঢুকিনি। কারন আমাদের নসিপুর রাজবাড়ি যাবার তাড়া ছিল।
          একটা বিশেষ ঘটনার উল্লেখ না করলে কাঠগোলা পর্ব সম্পূর্ণ হবেনা।বাগানে প্রবেশের আগে খানিকটা চেকপোষ্টের মত দেখতে একজায়গায় টিকিট কাটতে হয়। সেখানেই একজন বয়স্ক গাইড আমাদের সাথে দরকষাকষি করলেন। তারপর আমাদের নিয়ে আমবাগানের মধ্য দিয়ে নানা তথ্য দিতেদিতে এগিয়ে চললেন। আমবাগান পেরিয়ে যখন বাগানবাড়ি চত্বরে পৌছলাম তখন একটি কমবয়সি ছেলেকে ডেকে আমাদের বললেন,—“এ আমার ভাগ্নে। এ এবার আপনাদের সব ঘুরে দেখাবে” ভালো কথা সে চলেছে আমরাও চলেছি। তার কিন্তু চোখ একটি গ্রুপের দিকে। কোনও রকমে আমাদের বলে দিয়ে সে ছুটে ঐ গ্রুপটিকে ধরল। বেড়োবার সময় অরিঞ্জয়দা ঠিক ধরলেন সেই বুড়োকে! “আপনার লোক কিন্তু ঠিকমত দেখায়নি আমাদের। এরকম জানলে আমরা আপনাকে নিতাম না। আপনাদের যখন সময় ছিলনা তখন আমাদের নিলেন কেন?আমরা অন্য গাইড নিতাম। আপনি এটা ঠিক করুন নি। আমাদের পরিচিতরা এলে আমি বারন করে আপনার কাছে আসতে”।  অরিঞ্জয়দার কথা শুনে তো ভদ্রলোচ বেজায় অপ্রস্তুত। বলে— চলুন আর একবার দেখবেন। আমরা রাজী না হওয়ায় উনি ছেলেটিকে ডাকলেন। চেচামেচি শুনে আর একটি ছেলে এগিয়ে এল। কথাবার্তায় বুঝলাম এ  বিরোধি পক্ষ। ওদের ঐ অবস্থায় ছেড়ে আমরা বেড়িয়ে এলাম। কারন আমাদের নশীপুর যেতে হবে।

মুর্শিদাবাদ ৭

কাঠগোলা থেকে বেড়িয়ে আমার আর ভালো লাগছিল না। শরীর যেন আর নিতে পারছিল না। এদিকে সন্ধ্যেও হয়ে আসছে। এখান থেকে আমরা গেলাম জগৎ শেঠের বাড়ি। লোকালয়ের মধ্যে বাড়ী। কাঠগোলায় যে মাটির নিচের রাস্তাটা দেখেছিলাম, সেটার শেষভাগ টা দেখলাম। যদাও সেটা বন্ধ। চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে খানিকটা অন্ততঃ খুলে দেওয়া যায়। গাইড আমাদের নিয়ে গেল মাটির নিচে ঘরে । যেটা জগৎশেঠের টাঁকশাল ছিল। এখানেও একটা ছোটখাট মিউজিয়ম আছে। সেই সময়কার টাকা, সোনার জরির বেনারসি।, থালা বাসন,অস্ত্র আর একটা আসল মসলিন শাড়ী। জগৎ শেঠের মেয়ের বিছানা ও পোট্রেট দেখলাম।
                ওখান থেকে যখন বেরলাম সন্ধ্যে হয়ে গেছে। ভুতুরে ভুতুরে লাগছিল।  নসিপুর রাজবাড়ীর কিছুই ঠিকমত দেখতে পাবনা। আমি আর অরিঞ্জয়দা তাই নসিপুর যাবার বিরোধিতা  করে যাচ্ছি । কিন্তু ড্রাইভার সেদিনই আমাদের নসিপুর দেখাতে চায়। ওর বক্তব্য হল আজ এদিকটা শেষ করেনিলে সুবিধা হবে। এই তর্কবিতর্কের মাঝে আমরা এসে নামলাম রাজবাড়ীর সামনে। কিনতু রাজবাড়ীর চেহারা দেখে আমার মন খারাপ হয়ে গেল। যেহেতু আমরা প্রথমে কাসিমবাজার রাজবাড়ী দেখেছিলাম। এর আড়ম্বরপূর্ণ চেহারা আমার মনে রাজবাড়ীর একটা প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি করেছিল। তার সাথে আমি নসিপুরকে মেলাতে পারছিলাম না। এর মালিক যে ইতিহাসে কুখ্যাত।  তার সেই নোংরা নিষ্ঠুর চেহারাই কি তার বাসস্থানে পরেছে! অরিঞ্জয়দা আর রাজা দুজনে টিকিট কেটে গাইড ঠিক করে রওনা দিল। ভিতরটা স্যাঁতস্যাতে একটা পোড়োবাড়ীর মত এবং ভিষণ অন্ধকার।

ইতিহাস বর্ণিত কুখ্যাত দেবীসিংএর বাড়ী ছিল এটি। দেবীসিং পানিপথের এক ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে মুর্শিদাবাদ এসেছিলেন ব্যবসা করতে।  কিন্তু এখানে এসে দেখলেন ইংরেজ ও ফরাসিরা চুটিয়ে ব্যবসা করছে যেখানে অন্য কারও ঢোকা রিতীমত অসম্ভব।  তখন তিনি নবাবের অধীনে চাকরির চেষ্টা করতে থাকেন। অবশেষে দেওয়ান রেজা খাঁর অধিনে চাকরী পেতে সমর্থ হন। ধীরে ধীরে ইংরেজদের বশীভূত  করে তিনিই ঐ বিভাগের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন এবং এই নসিপুরে বাড়ী তৈরী করেন। এই দেবী সিং ইংরেজদের  সুনজরে থাকার জন্য ৭৬এর মন্বন্তরের সময়ও রাজস্ব আদায় থেকে বিরত থাকেন নি। তার অত্যাচার থেকে শিশু বৃদ্ধ মহিলা কেউ বাদ যেত না।

আমরা  ঢুকেই সদর দরজার পাশে একটা ছোট্টমন্দির দেখলাম। তার পাশে একটা ছোট কুঠুরি মত জায়গায় একটা কালো ছেঁড়া জোব্বা আর একটা গাধার মত টুপি ছিল। ওটা পরেই নাকি দেবীসিং প্রানদন্ড দিতে যেতেন। আমি দুবার ফটো তুলতে গিয়ে দেখলাম ফ্লাসটা কাজ করছেনা। এখন মনে হয় কাজ না করে ভালোই হয়েছে।  কি লাভ হত ঐ নিষ্ঠুর বিভৎসতির সাক্ষীর ফটো তুলে।যাইহোক আবার মোবাইলটা বিগরালো নাকি পরীক্ষা করতে গিয়ে আমি পিছিয়ে পরেছিলাম। দ্রুত হেটে ওদের নাগাল যখন পেলাম তখন গাইড বলে চলেছে দেবীসিংএর নিষ্ঠুরতার কাহিনী । —“এই সেই জায়গা যেখানে প্রাণদণ্ড দেওয়া হত যারা খাজনা দিতে পারতনা তাদের”। আমার আধ হাত দূরত্বে শূন্যে ঝুলছে সেএ ফাঁসির দড়ি। পরক্ষনেই গাইড আমার পায়ের তলাটা নির্দেশ করে বলে উঠল—“আর এইখানে ছিল তিনটে গর্ত যেখানে পরে মৃতমানুষ গুলো গড়িয়ে  সোজা চলে যেত ভাগিরথীতে”। এত তাড়াতাড়ি ঘটনাটা ঘটলো আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম আমার সর্বশরীর কাঁপছিল জানিনা কেন। হয়ত ঘেন্নায় অথবা রাগে। শুনলাম ঐ গর্তে একটি শিশু পড়ে যাবার পর ওগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়।
                দেবীসিংএর নিজের কোনও সন্তান ছিলনা। হয়ত বিধাতা চান নি এই নিষ্ঠুরতার কোনও উত্তরাধিকার রখতে অথবা এই রক্তের কোনো বীজ তিনি রাখতে চান নি এই পৃথিবীতে। দেবীসিং তার ভাইএর ছেলেকে দত্তক নিয়েছিলেন। বর্তমানে যিনি আছেন তিনি ওনারই বংশধর । 
            এখানে একটি কালীমন্দির আছে। খুব নাকি জাগ্রত। এখানেই আমরা হীরা বাঈএর ফটো দেখলাম। যদিও কাল তার ছাপ ফেলায় মলিন হয়ে গেছে।

আমরা যখন বেড়লাম ঘড়ি বলছে খুব একটা রাত হয়নি কিন্তু আবহাওয়া বলছিল বেশ রাত। অরিঞ্জয়দা ড্রাইভারকে বলল এমন একটা দোকানে দাঁড়াতে যেখানে ভালো শাড়ী পাওয়া যায়। আমারও ইচ্ছা ছিল মুর্শিদাবাদ সিল্ক কেনার কিন্তু সেটা দোকান থেকে নয় উৎপাদন কেন্দ্র থেকে। আমি আগেই জিগ্গেস করেনিয়েছিলাম ড্রাইভারকে। ড্রাইভার বলেছিল উৎপাদন কেন্দ্র অনেক দূর। তাই আমি সিল্ক কেনার ইচ্ছা ত্যাগ করি। রাজা আর অরিঞ্জয়দা একটা মিস্টির দোকানে মিস্টি কেনার নাম করে গপগপ করে মিস্টি খাচ্ছে আর আমরা রাস্তার উল্টোদিকে টোটোতে বসে ওদের কান্ড দেখছি।  এতটাই অবাক হয়েছি যে হাঁ করে ঐদিকেই তাকিয়ে আছি। একটু পরে দুই বন্ধু মিস্টি কিনে নিয়ে এল। শরীর এবার বিদ্রোহ করছিল। হটেলে ফিরে চললাম সকলে।

মুর্শিদাবাদ ৮

এদিন সকাল থেকেই আমরা উত্তেজনায় ফুটছিলাম। আজই যাব আমরা সিরাজের সমাধি দেখতে। মুর্শিদাবাদের ইতিহাসে নানারকম ঘটনার ঘনঘটা কিন্তু মুর্শিদাবাদ মানে সিরাজই। সিরাজের যে বাসস্থান,যেখানে পরবর্তীকালে কিছুকাল মিরজাফরও বাস করেছিলেন,সেখানে আর যাওয়া যায়না। ঘন জঙ্গল সেখানে। শুধু জায়গায় জায়গায় ভিত্তিপ্রস্থ দাড়িয়ে রয়েছে। শুনে মন খারাপ হয়েগিয়েছিল।কিন্তু এটা ভেবে আনন্দিত ছিলাম য সমাধি তো দেখতে পাবো।
            ন’টা কি সাড়ে ন’টা হবে ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু’।এদিনের যাত্রা আমার সুন্দর স্মৃতিগুলোর মধ্যে একটি। টোটোতে চেপেই শুনলাম আমরা ভাগীরথীর ওপারে যাব। ঘাটে এসে দাঁড়ালাম। আমাদের ড্রাইভার বলেদিলো কি বলে টিকিট কাটতে হবে। আগেই শুনেছিলাম আমাদের টোটোও যাবে আমাদের সাথে। ওমা! তাইতো! প্রথমে টোটো উঠে মাঝখানে দাড়ালো। তার পাশ দিয়ে আরও একটি টোটো একটা বাইক ও খান দুই তিন সাইকেল তার আরোহী সুদ্ধ নৌকার মানে ট্রলালরের মাঝখানে উঠে দাঁড়ালো আর দুই ধারে ফাকা জায়গায় মানুষ দাঁড়ালো। সবাই উঠে যাবার পর চালক ঘাটের খুঁটি থেকে দড়ি খুলে তরতর করে নৌকার পেটের মধ্যে ঢুকে গেল। তারপরএকটা রেঞ্জের মত জিনিস একটা জায়গায় লাগিয়ে পাঁইপাঁই করে ঘোরাতে লাগলো। একটু পরেই ভ্যাটভ্যাট করে আওয়াজ করে উঠলো যন্ত্রটা। তখন লোকটা উপরে উঠে এসে একদম শেষ দিকে চলে গেল আর একটা দড়ি ধরে নৌকাটাকে এদিক ওদিক করে অন্য পাড়ে পৌছে দিল। বাবুই তো ভয়ে ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রাজা সুতপার কাছ থেকে একটা চকলেট চেয়ে বাবুই কে দিল। তাতে কিছু লাভ হল কিনা জানিনা। কিন্তু ব্যাপারটা দারুন ছিল।

প্রথমে আমরা গেলাম সুজাঊদ্দিনের সমাধি। ইনি ছিলেন বাংলার দ্বীতিয় নবাব, মুর্শিদকুলি খাঁর জামাতা। খুবই আরম্মরহীন সমাধি আর তার সাথে একটি মসজিদ। রাজা অরিঞ্জয়দা আর সবুজের ফটো চলল মসজিদের  সামনে। সুতপাকে ফটো তোলার জন্য খুব অনুরোধ করতে হয়। এখানে ও নিজেই বাবুইয়ের সাথে একটা ফটো তুলল।
               এরপর আমাদের গন্তব্য জগদ্বন্ধু মন্দির। বিশাল বড় মন্দির চত্বর। একপাশে সরষে ফুলে সবুজে-হলুদে একাকার আর অন্যদিকে ছায়ায় ঘেরা জলাশয়। সুন্দর শান বাঁধানো ঘাট। একটা আখের রসওলা কে দেখে লাইন দিয়ে সব বসে পড়লো রস খাবে বলে। ডিসেম্বর মাস হলে হবে কি ঠান্ডা নেই একফোটা তায় ওপর ঠাটাপোড়া রোদ, আখের রসের কম্বিনেশনটা দারুন হবে তা বলাইবাহুল্য। আখওলা বকবক করতে করতে তার কাজ করছে আর সবাই রসেয় প্রতীক্ষা করছে। এখানকার লোকেরা ভীষণ সহজ সরল। ভেজাল দিতে শেখেনি। তারওপরে আমরা কোলকাতা থেকে গেছি শুনে আমাদের সবাই খাতিরও করছিল।
                    আমাদের পরের গন্তব্যস্থল হল কিরীটেশ্বরীর মন্দির। কিরীট মানে কপাল। এখানে মা সতীর কপাল পড়েছিল। তাই এটি ৫১ পীঠের অন্যতম। আমরা আগে গ্রামের মধ্যে গর্ভগৃহ দেখে এসেছি। কথিত আছে মুর্শিদকুলী খাঁ যখন সব মন্দউর ভেঙ্গে ফেলছেন এক এক করে তখন এই মন্দিরের পূজারী মূল বিগ্রহ লুকিয়ে গ্রামের মধ্যে নিয়ে যান। পরে মুর্শিদকুলী খাঁ মারা যাবার পর নটুন করে মন্দির স্থাপন হলেও গর্ভগৃহে এখনও পূজা হয়। এই গল্প কোনও ইতিহাস   বইতে পাওয়া যায়না। এ আমরা জেনেছিলাম পূজারীর মুখ থেকে,সুতপার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন। আমরা যখন পাকা মন্দির দেখলাম পাশে সেই ভগ্ন মন্দির কেও পেলাম। ওর ভগ্নতাও এক ইতিহাস। এই মন্দিরেরও চারপাশে  ফাঁকা জমি। অবস্থা দেখে মনে হল কালপরশু যেন কোনো মেলা হয়েছিল। মেলার ভাজাভুজির দোকান তখনও রয়েছে। ওরা বলল মঙ্গল আর শনিবার ওখানে মেলা বসে। আমরা মেলার দোকান থেকে টুকিটাকি খাবার জিনিস কিনে একটা চৌকির ওপর বসে খাচ্ছিলাম আর আমার বারেবারে চোখ চলে যাচ্ছিল ঐ ভাঙ্গা মন্দিরটার দিকে। মনে হচ্ছিল কি অদ্ভুত ভাবে যখন কোনও কিছু তৈরী হয়েছে তখন যেমন সেটা ইতিহাস হয়েছে আবার যখন ভাঙ্গা হয়েছে তখনও সেটা ইতিহাস হয়েছে। তখনও মন্দির ভেঙে মসজিদ হত । সেকাল আর একাল। অনেক মডার্ন হয়েছে একাল কিনতু মানষিকতা কি এতটুকু বদলেছে মানুষের?

মুর্শিদাবাদ ৯

আমার যেন আর আর তর সইছিল না। আমি অধৈর্য  হয়ৈ বললাম ড্রাইভারকে খোসবাগ কখন যাব! গম্ভীর,ঝোলা গোঁফ ড্রাইভার মুচকি হেসে বলল “এই তো এখন”। প্রবল উৎসাহে উঠে বসলাম গাড়ীতে।
              আমরা শহর ছেড়ে গ্রামের পথ ধরেছি। লক্ষ্য করে দেখেছি এখানে মধ্যবিত্ত বা ধনী লোকের সংখ্যা একেবারে নেই বললেই চলে। আমরা পাকা রাস্তা পেয়েছি। কিন্তু তার পাশে রয়েছে সরষে ফুলে হলুদ ক্ষেত। এ দৃশ্য আমাদের কোলকাতায় না দেখা গেলেও কোলকাতা ছাড়লেই দেখা যায়। তবে যে দৃশ্য আমি দেখিনি তা হল ক্ষেত ভর্তি ফুলকপি, বাঁধাকপি, টম্যাটো, পুঁইশাক। এদৃশ্য যেন উপরি পাওনা। মাটির বাড়ী গুলো এত সুন্দর করে সাজানো। কারো দু কামরার কারো আবার বেশ বড়।সুন্দর করে নিকানো উঠান। কারো আবার মাটির বাড়ির দেয়ালে পুরোনো হয়ে যাওয়া আলপনা। আমরা একটা বিয়ে বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখলাম বাড়ীর গায়ে আলপনার ছড়াছড়ি। আলপনা এখানে ডেকরেশনের মূল মাধ্যম। যাদের ছোটখাট  বাড়ী তারাও ছোট্ট উঠানে সবজি ফলিয়েছে। এইভাবে চলতে হঠাৎ সুতপা চেঁচিয়ে উঠলো,—“ গুটিপোকা, গুটিপোকা , এই দাঁড়াও দাঁড়াও বাচ্চাদের দেখাবো।” আমরা বেশ থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম। সুতপার এক নিকট আত্মীয়র গ্রামে বিশাল বাড়ী জমিজমা। সুতপা সেখানে বেড়াতে যায়।  তাই ও এইসবের সাথে পরিচিত। নইলে আমরা তো বুঝতেও পারতাম না এগুলো কি। আমরা হুড়মুড় কর নামলাম। রাস্তার ধারে রোদের দিকে মুখ করে রেখেছে সাড়ে তিন ফুট বাই আড়াই ফুট চারটি বোর্ড।  বোর্ডের গায়ে গোলগোল করে দড়ি আর খর লাগানো। আর তার মধ্যে সাদা সাদা পোকা গুলো হেঁটে বেড়াচ্ছে। কোনো কোনো টা হলুদ গুটি বানিয়েও ফেলেছে।  আমাদের কথাবার্তা  শুনে ভিতর থেকে একটা বউ বেড়িয়ে এসেছিল। সুতপা জিগ্গেস করাতে সে বলল, ঐ বোর্ডগুলি সিল্ক কারখানা থেকে দিয়ে যায়। এরা ওগুলো রোদে ফেলে পাহারা দেয়।  রোদ চড়া হলেই পোকা গুলো গুটি বাঁধে। সব গুটি হয়ে গেলে কারখানা থেকে লোক এসে এগুলো নিয়ে যাবে আরও বোর্ড দিয়ে যাবে।
                 আমাদের গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে। একটা অদ্ভুত ভালোলাগার রোমাঞ্চ আমি অনুভব করছিলাম। অবশেষে আমরা পৌছলাম খোসবাগ, সিরাজের সমাধি।

জুতো খুলে পা ফেলতেই ঠান্ডা যেন ব্রহ্মতালুতে গিয়ে লাগল। আমার ধারণা ছিল এখানে শুধু সিরাজেরই কবর আছে। কিন্তু তানয়!আমরা প্রথমেই ঢুকলাম একটা ছাদ ছাড়া ঘরের মত জায়গায় যেখানে সিরাজের দিদিমা সরফুন্নীসা বেগম, সিরাজের মা আমিনা বেগম এবং মাসি মুনিরা বেগমের সমাধি রয়েছে। যেহেতু তাঁরা পর্দানসীন তাই তাঁদের সমাধি ঘিরে দেওয়া হয়েছিল।এখান থেকেই আবার আমার শরীর খারাপ করতে শুরু করলো। আমরা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলাম অথবা বলা যেতে পারে ভেতরে ঢুকলাম। সান বাঁধান রাস্তা সোজা চলে গেছে সামনে, দেখতে পাচ্ছি সিরাজের সমাধি মন্দির। কিন্তু গাইড আমাদের ডানদিকে নিয়ে গেলেন। আমরা কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। সেখানে একই সঙ্গে ছোটবড় মিলিয়ে ১১টি কবর। আমি ভাবলাম এই কবর দেখে কিকরবো! গাইড বলে চলেছেন, সিরাজ যখন বন্দী ছিলেন তখন ওনার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন বাংলাদেশ থেকে ১১জন আত্মীয়। কিন্তু মীরজাফর পুত্র মীরমিরন এঁদেরকে এক সাথে খাবারে বিষ দিয়ে মেরে ফেলে। তার ইচ্ছা ছিল মৃতদেহগুলো গুম করে দেবার কিন্তু ইংরেজরা রাজী হননি। তারা এইখানে মৃতদেহগুলি সমাধিস্থ করেন। আমার  ঐ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে মনে মনে মীরমিরানের ওপর যেমন ঘৃনা হচ্ছিল তেমনি ইংরেজদের ওপর হচ্ছিল শ্রদ্ধা। সকলে ঐ জায়গাটা ঘুরে দেখছিল আমি ঐ একই জায়গায় দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু  বাঁদিক যেন একটা টান অনুভব করছিলাম,যেন কেউ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। আমি জোর করে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করেও পারলাম না। ওদিকে আমায় যেতেই হল। গিয়ে দেখলাম একটা ছোট কবর। গাইডকে জিগ্গেস করলাম,এটা ছোট কেন,কোনো ছোট মানুষের কবর কি এটা? উনি বললেন, সাইজ দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। যেহেতু সকলে এক সাথে মারা গিয়েছিলেন তাই কারোরই পরিচয় জানা যায়নি। কে ছিল এখানে? আমারই কি পূর্বজন্মের কেউ? আমাকে এইভাবে আকৃষ্ট করছিল কেন? আমার কি খুব নিকটজন ছিল সে?মনে অনেক প্রশ্ন নিয়ে নেমে এলাম ওখান থেকে। মন বলছিল আর একটু দাঁড়াই ওখানে। সেই সময় রাজার ডাক শুনলাম,— “চলো ওরা এগিয়ে গেছে”।  মনে মনে তাঁকে বললাম তুমি ঘুমাও শান্তিতে।
                   নেমে এসে সান বাঁধানো রাস্তা দিয়ে কয়েক পা গেলাম। বাঁদিকে ঘাসে মোরা ছায়ায় ঘেরা এক খন্ড জমির ওপর তিনটি কবর। গাইড বললেন এটি হল সেই পীরের কবর যিনি পুরস্কারের পরিবর্তে সিরাজকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন মীরজাফরের হাতে।সিরাজ যখন স্ত্রী লুৎফা ও কন্যা কে নিয়ে  পালিয়ে যাচ্ছিলেন ছদ্মবেশ ধারণ করে তখন তিনি জুতোটি পরিবর্তন করতে ভুলে গিয়েছিলেন আর সেই জুতো দেখেই পীর চিনে ফেলছিল এবং ধরিয়ে দিয়েছিল। ইংরেজ বিশ্বাসঘাতকতা মাপ করেনি। পীরের প্রাণদন্ডের পর তাঁকে এখানে সমাধিস্থ করা হয়। পাশে রয়েছে তাঁর স্ত্রী ও পুত্রের কবর।
                        এবার আমরা এগিয়ে গেলাম আসল সমাধি মন্দিরের দিকে যেখানে শায়িত আছেন নবাব আলীবর্দী খাঁ, সিরাজ ও ভাই এবং সিরাজের স্ত্রী লুৎফা। এটি তৈরি করেছিলেন আলীবর্দী খাঁ নিজে তাঁর নিজের জন্য। পরে তাঁর প্রিয় নাতিকেও এখানে সমাধিস্থ করা হয়। ইংরেজরা বাংলাদেশে নির্বাসিত  লুৎফাকে নিয়ে আসেন এই সমাধিমন্দির দেখাশোনার জন্য এবং তাঁর মাসহারারও বন্দবস্ত করে দেন।
                       আমরা সমাধিগৃহে প্রবেশ করলাম। শিউর উঠলাম সিরাজের সমাধি দেখে। কাটরা মসজিদের  গাইড তন্ময় বলেছিল,—“দেখবেন নবাব সিরাজদৌল্লার সমাধি চার ফুটের বেশী হবে না। কিকরে হল! সিরাজদৌল্লা তো ছিলেন পোনে সাতফুট লম্বা। আসলে তাঁকে টুকরো টুকরো করেছিল মীরজাফরের ছেলে মীরমিরণ।” ইতিহাস বলছে সেই টুকরো নিয়ে এসে মা আমিনা বেগম এখানে সমাধিস্থ করেছিলেন। পাশে শায়িত সিরাজের ছ’বছরের ভাই। সেও ছিলেন মীরমিরণের আর এক নিষ্ঠুরতার বলী। সিরাজের সমাধির পাশে তাঁর প্রিয়পত্নী লুৎফার সমাধি। আমরা পাশের ঘরে প্রবেশ করলাম যেখানে নবাব আলিবর্দি খাঁর সমাধি । আকার দেখে মনে হল তিনিও ৬ফুটের ওপরে লম্বা ছিলেন। প্রতিটি সমাধিমন্দিরের সাথে মসজিদ দেখেছি এখানেও তার ব্যতিক্রম নেই।

আবার আমরা নৌকায় চাপলাম ফিরে আসার জন্য।  কিন্তু মন পরে রইল ঐ খোসবাগে। কত নিষঠুরতা, কত কষ্ট, কত হাহাকার চাপা পরে থাকে ইতিহাসের তলায়। কতটুকু খোঁজ আমরা রেখেছি কতটুকু সমব্যথী আমরা হতে পেরেছি। সন্তানের মৃত্যু কষ্টের কিন্তু যে মৃত্যু নিষ্ঠুরতা অবলম্বন করে সম্পন্ন হয়েছে। তাকে কি শুধুই ‘কষ্ট’ বলা যায়! মুর্শিদাবাদের ইতিহাস  বড় বেদনাময়। এর মাটিতে বাতাসে এখনও যেন নিষ্ঠুরতা আর হাহাকার।

মুর্শিদাবাদ ১০

আবার আমরা ট্রলারে উঠলাম। এবার বাবুই অনেকটা ফিট। আমার হাল্কা জ্বর আসছিল। কিছু ভালোলাগছিলনা। নৌকা ছেড়ে আমরা টোটোতে উঠেছি। সবাই খুব খুশী। মুর্শিদাবাদ দর্শন আমাদের প্রায় শেষ। কাল আমরা ফিরে যাব।
        আমরা মোতিঝিল এসে গেছিলাম।এইঝিলে এক সময় মোতি মিনে মুক্তোর চাষ হত। সেই কারনে এই নাম। এই মোতিঝিলের ধারেই ছিল ঘসেটি বেগমের প্রাসাদ। ঘসেটি বেগমের প্রচুর ধনরত্ন ছিল। কথিত আছে সিরাজ যখন জানতে পারলেন যে ঘসেটি তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন তখন তাকে বন্দী করেন এবং তার সমস্ত ধনরত্ন আর ঘসেটির দাসীদের একটা জানলাহীন ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে ঘরটা সীল করে দেন। পরবর্তীকালে ইংরেজরা এটি ভাঙ্গার জন্য কামানদাগে। কিন্তু ওটা ভাঙ্গা যায়নি। উপরন্তু যেসব শ্রমিকগণ কাজ করছিলেন তারা মুখে রক্ত উঠে মারা যায় ও যেই ইংরেজ ভদ্রলোক এসব তদারক করছিলেন তিনি পরে সুইসাইট করেন। আমরা সেই ঘরটিদেখলাম।  কিন্তু আমার মাথায় এটি এলোনা যে সিরাজ নাকি খুব বিলাসী ছিলেন। তাহলে অত ধনরত্ন ঘরটার মধ্যে বন্ধ করতে গেলেন কেন? নিজে না নিতেন, ওনার বিরোধী পক্ষকে তো উপঢৌকন হিসাবে তো দিতে পারতেন তাহলে হয়ত ওনার এই পরিনতি হতনা!
                   এখানে একটি মসজিদ আছে যেটি কালা মসজিদ হিসাবে খ্যাত। আমরা দেখলাম কয়েকজন এখানে নমাজ পরছিলেন। ঘসেটি বেগমের নিজের কোনো সন্তান ছিলনা তাই তিনি সিরাজের ভাই একরামদৌল্লাকে দত্তক নেন। একরামদৌল্লা কম বয়সে মারা যায়। এতে ঘসেটি বেগমের স্বামী মহম্মদ নৌজেস খুব ভেঙ্গে পরেন ও মারা যান। এই দুজনের সমাধিই এখানে রয়েছে। কিন্তু অবহেলায় তা প্রায় ভগ্নদশাগ্রস্ত। 
                   জায়গাটা আমগাছের ছায়ায় ঘেরা। আমার জ্বরটা বেশ চড়চড় করে উঠছে কিছু ভাল লাগছিলনা। ব্যগে ওষুধ ছিল। অপেক্ষা না করে খেয়েই নিলাম। এই মোতিঝিলের একদিকে একটা পার্ক আছে যেখানে সন্ধ্যেবেলা লাইট এন্ড সাউন্ড দেখায়। সকলে প্ল্যান করলো আসবার তাই রাজা আর অরিঞ্জয়দা গেল টিকিট কাটতে। বাবুই সবুজও গেল,আমিআর সুতপা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে কাঠের জিনিস গুলি দেখছিলাম। ওরা টিকিট কেটে আসার পর আমরা হোটেলের দিকেই রওনা দিলাম। তার দুটো কারন ছিল। প্রথমতঃ দুপুরের খাবার সময় হয়ে গিয়েছিল। আগেরদিন পরীক্ষামূলকভাবে অন্যহোটেলে খেয়ে খাওয়াটা ঠিক জমেনি। আমার মাছের ঝোলটা পুরো ফ্রীজ থেকে বার করে দিয়েছিল আর ‘ঠাকুরের’ থেকে দামও বেশী ছিল। তাই আজ আর কোনো রিস্ক না নিয়ে ‘পুনঃ মুসিক ভবঃ’। আর দ্বিতীয়তঃ আমাদের ড্রাইভারের বোন অসুস্থ হয়ে বহরমপুর হসপিটালে ভর্তি হয়েছে তাই ওকে যেতে হবে। তবে ও কথা দিল যে আর একজন ড্রাইভারকে গাড়ি দিয়ে পাঠিয়ে দেবে।
               আমি কোনরকমে খেয়ে গিয়ে শুয়ে পরলাম। আমার পক্ষে আর যাওয়া সম্ভব ছিলনা। ওরা সাড়ে চারটার সময় বেরোলো। আমায় ডেকে দিয়ে। ফিরলো ৮টায় ততক্ষনে আমার একপ্রস্থ কফি খাওয়া হয়ে গেছে।

আজ সকলেরই মন খারাপ কাল আমরা কোলকাতা ফিরে যাব। আমার শুধু মনে হচ্ছিল এ যেন কেবলই ইতিহাস কে ফেলে যাওয়া নয়। এযেন কতগুলো রক্তমাংসের মানুষের সাথে কদিন কাটিয়ে যাওয়া। তাদের ব্যবহার্য দেখে মনে হয়েছে যেন একটু আগেও তাঁরা এই খানেই ছিলেন।  হ্যাঁ ছিলেন, মাত্র ১৫০ বছর আগে। মুকুট,সিংহাসন  সব পরে আছে শুধু রাজাই নেই।

মুর্শিদাবাদ ১১

সকালে ঘুম ভাঙ্গলো অরিঞ্জয়দার ডাকাডাকিতে। নিজের ঘর থেকেই উনি ডেকে যাচ্ছিলেন রাজাকে। উঠছি উঠবো করতে করতেই দরজায় টোকা চা এসে গেছে। চটপট স্নান সেরে নীচে নেমে এলাম লটবহর সমেত। আমাদের ট্রেন বিকেল সাড়ে চারটায়। এর মধ্যে আমরা আর হোটেলে ফিরব না তাই ঘর ছেড়ে জিনিসপত্র রিসেপসনে রেখে আমরা বেরিয়ে পরলাম।
                  প্রথমেই নশীপুর আখরা। এখানে রমানুজ সম্প্রদায়ের সাধুসন্তগন আছেন। এখানে রথযাত্রা ঝুলনযাত্রা উৎসব গুলি হয়। তখন দুটি বড় বড় পিতলের ও একটি রূপার রথ বার করা হয়। রূপার রথটি অসাধারন! একটি রূপার মাঝারী ট্রলীর ওপর রূপার হাওদা ও মাহুত সুদ্ধ হাতি বসানো। রূপার হাতির ঝালরের নকশা কিন্তু করা সোনা দিয়ে করা। বড়বড় থালা বাসন রয়েছে যেগুলি উৎসবের সময় ব্যবহার করা হয়। একটা মোটর গাড়ি দেখলাম যার মডেলের নামটা মনে নেই,সেইসময় তার মূল্য ছিল ৮০টাকা! এখানে একটি মন্দির আছে। আমি আর অরিঞ্জয়দা সেখানে ঢুকিনি জুতো খোলার আলসেমীতে। তবে শুনলাম সেখানে একটি বিশাল ঝাড়লন্ঠন আছে।
          সেখান থেকে এবার আমরা গেলাম আজিমুন্নীষা বেগমের সমাধি দেখতে। ইনি ছিলেন নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর একমাত্র কন্যা। কথিত আছে ওনার এক দূরারোগ হয়েছিল। হাকিম অসুধের সাথে একটি করে বাচ্চার কলিজা খেতে বলেছিলেন। এই জন্য উনি ইতিহাসে ‘কলীজাখাকি’ নামে কুখ্যাত। বাবার মত ওনারও সমাধি সিঁড়ির তলায় রয়েছে। প্রতি সমাধির সাথে একটি মসজিদ দেখেছি। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু শুধুমাত্র একটিমাত্র দরজা ও তার সংলগ্ন কিছুটা দেয়াল অবশিষ্ট রয়েছে। বাকী পুরো মসজিদটিই ভুমিকম্পে বিলীন হয়ে গেছে।
         মুর্শিদাবাদে এসে কবর দেখলাম বটে! একটা কবরস্থান ‘এগারোশো’ কবর বলে পরিচিত। লোকে সেখানে আবার গাইড নিচ্ছে কোনটা কার কবর চিনে নিতে। এখানে মীরজাফরের বংশের সকলের কবর রয়েছে। যাঁদের আমি চিনিনা তাদের কবর চিনে কিকরব! তবে আশ্চর্য লেগেছিল দুটো একফুট কবর দেখে। জেনেছিলাম ওদুটো মীরজাফরের পোষা দুটি পায়রার কবর।
                     হাতে সময় ছিল আমরা তাই আবার ফিরে এলাম হাজারদুয়ারী। কিছু ফটো তোলা হল। বাবুইয়ের চাবির রিং ,যেটা প্রথমদিন এখান থেকে কিনেই ব্যগে লাগানো হয়েছিল,তার পুতুলটি মোতিঝিল পার্কে হারিয়ে গিরেছিল। সেটি কেনা হল। নদীর তির ধরে বেশ বড় ঘর-সাজানোর কাঠের জিনিষের দোকান। আমি আর সুতপা দেখবার জন্য এগিয়েগেলাম। কিন্তু এক-এক দোকানে এক-একরকম দাম।
                   আমাদের বহরমপুর যাবার দরকার ছিল কারন আমি শোলার কাজ কিনবো আর সুতপা কিনবে শাড়ী। আমরা যখন পৌছলাম তখন ১টা বেজে গেছে।  খিদে পেয়েছে জোর। তার ওপর আমার জ্বর বেশ উচ্চ মাত্রায়। ‘অজন্তা’ হোটেলে পেট পুরে খেলাম। ওখান থেকে বেরিয়ে প্রথমে সুতপার শাড়ী কেনা হল। আমরা ভীষণ তাড়াহুড়ো কর ছিলাভ কারণ আমাদের ৪-২০তে ট্রেন।
              বাজারের মধ্যে একজনকে জিঞ্জেস করা হল শোলার কাজের দোকান কোথায়। তিনি বললেন দোকান এখন উঠে গেছে কিন্তু ওখানে ফোন নাম্বার আছে আপনারা ফোন করে দেখতে পারেন। বন্ধ দোকানের পাশে ফ্লেক্সে দেওয়া নাম্বারে রাজা ফোন করে ভদ্রলোকের বাড়ীর ডিরেকসন নিল। আমাদের ড্রাইভার অলি-গলি চেনেনা। তাই একেতাকে জিজ্ঞেস করে বাড়ীটাতে পৌছলাম। একটি দূর্গার মুখ কিনে টোটোতে উঠলাম। সবার মনবাঞ্ছা পুরণ হয়েছিল। গাড়ী তাই ছুটে চলল লালবাগ। ‘ঠাকুর’ কে বলাছিল মাংস আর রুটি করে রাখার জন্য। টিফিন বক্সে মাংস আর রুটি নিয়ে নিলাম রাতের জন্য। ঠিক সময়ে ট্রেনে চেপে বসলাম কোলকাতা অভিমুখে। 

মুর্শিদাবাদের নবাবি আমল শেষ হয়ে গেছে ১৫০ বছর আগে। কিন্তু এখনও এখানে অদৃশ্য নবাব তার রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছেন। এখানে এলে এখনও মনে হয় দিল্লীর মসনদে ঔরঙ্গজেব অধিষ্ঠিত। এখনও এখানকার মানুষ সেই নবাবি, সেই মুঘল শাষনের গরিমাকে অক্ষুণ্ণ রেখেছে। এখনও তারা নবাব সিরাজদৌল্লার নামে সেলাম করে। মীরজাফর কে তারা নেমকহারাম বলতে নারাজ। তারা বলে মীরজাফর ষড়যন্ত্রের বলী হয়েছিলেন।  সমান সন্মান তারা মীরজাফরের প্রতি ঞ্জাপন করে। সেই ঐতিহ্যশালী নবাবী সেখানে এখনও বিদ্যমান। শুধু নবাবরা সেখানে শুধুই সমাধি।

শেষ~~~~~