Saturday, 22 October 2016

হঠাৎ  সেদিন


আমি সাউথ সিটির ওপরের করিডোরে দাঁড়িয়েছিলাম। প্রথমেই ঢুকলো স্বাগতা। স্বাগতা এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত। আমি ব্যাগে হাত দিতে যাব ফোনটা বার করার জন্য ঠিক তখনই নীলাঞ্জন আর শৈবাল এক সাথেই ঢুকলো। আমি মজা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। ওরা দুজনেই একসাথে স্বাগতাকে ডেকে উঠলো। নীল ফোন বার করছে, আমিও ফোনটা বার করে হাতে নিলাম। সাথেসাথে ফোনটা বেজে উঠলো, “ওপরের রেস্ট্রুরেন্টে চলে আয়। আমি ওয়েট করছি”

স্কুলের চার বন্ধু ফেসবুকের কল্যানে ৪২বছর বয়সে আবার নতুনকরে বন্ধু হয়েছি। আমি,স্বাগতা আর শৈবালের দেখা করাটা কোনও ব্যাপার ছিলনা। চিন্তা ছিল নীলকে নিয়ে। ও থাকে ইউকে। আসবো বললেই আসা যায়না। কিন্তু সে অসাধ্য সাধনও হল,নীল এল। শৈবালকে দেখেই নীলের চোয়াল শক্ত হয়েগিয়েছিল। শৈবালকে ডাকতে বারন করেছিল নীল কিন্তু আমি না ডেকে পারিনি। আমার মনে হয়েছিল শৈবালের পরিবর্তনটা নীল নিজের চোখে দেখুক। শৈবালের পাশে আজ নীলেরই দাঁড়ানো উচিত। শৈবাল আজ সবচেয়ে একা। শৈবালও বোধহয় তাই চাইছিল। শৈবাল নিজে বসে আর একটাচেয়ার নীলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,“বস”। নীল ঘুরে আমার পাশের চেয়ারে এসে বসলো। কেউই কোনও কথা বলছেনা সকলের মনেই একে অন্যের প্রতি বহুবছর আগের বিদ্বেষ যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। আমি শৈবালকে জিগ্গেস করলাম “তোর শরীরের অবস্থা তো খুব খারাপ। রোগা হয়ে গেছিস, চোখের তলায় তো কালিও পরেছে!ডাক্তার কি বলল,রিপোর্টগুলো করিয়েছিস?”। আমার কথা শুনে নীল আর স্বাগতা মাথা নীচু করে থাকা শৈবালের দিকে তাকালো। ওদের ভাবখানা এই যে ‘যাক কেউ একজন কথা তো শুরু করলো’। “রিপোর্ট পজেটিভ” শৈবাল মুখ না তুলেই উত্তর দিল। সাথেসাথেই নীল আর স্বাগতার মুখে একরাশ বিষ্ময় মুখ দিয়ে সমবেত হয়ে বেরোলো, “মানে কী হয়েছে তোর”। দুজনেই অপার বিষ্ময়ে আমার দিকে একবার,একবার শৈবালের দিকে তাকালো। হ্যাঁ আমি জানতাম,বলিনি, চেয়েছিলাম শৈবাল নিজেই বলুক। 

“আমি এইচ-আই-ভি পজেটিভ”। ধারেকাছে  কোথাও বিকট জোরে বাজ পরলো। ক্ষনিকের জন্য গোটা সাউথসিটি মলটাই যেন থমকে গেল। কিন্তু আমাদের মধ্যে যে বাজটা পরলো তাতে আমাদের স্বাভাবিক হবার জন্য বোধহয় শৈবালের পরবর্তী কথাগুলোই দরকার ছিল। “মাসছয়েক আগে একটা কার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। প্রচুর ব্লাড লেগেছিল। তার মধ্যেই আমার মৃত্যুর পরোয়ানা ছিল”। শৈবালের কথা শেষ হতেই স্বাগতা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। নীল যেন কঁকিয়ে উঠলো,“এ তুই কি বলছিস!” নীল চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো ছোটবেলার প্রানের বন্ধুকে, “আমায় ক্ষমা করে দে।আমি বুঝিনি কেন লালি আজকে এখানে আসার জন্য দিব্যি দিয়েছিল”। শৈবাল চোখ মুছে হেসে বলল,“তুই আবার কবে থেকে দিব্যি মানতে শুরু করলি”। নীল চোখ মুছতে মুছতে বলল,“এখন আমার সব মানতে ইচ্ছা করে রে।হয়তো স্বাভাবিকতা টা মানলে আজ আর এই কষ্টটা পেতামনা”। 

শৈবাল স্বাগতার মাথায় হাত বোলায়। “তুই আগে কেন বলিস নি!” অনুযোগ করে স্বাগতা। “আগে জানলে কি করতি,  আমার ভালোবাসা অ্যাকসেপ্ট করে নিতি?” শৈবালের কথায় চুপ করে যায় স্বাগতা। হঠাৎ  ধীর গলায় বলে ওঠে “হয়তো নিতাম!”।  শৈবাল স্কুল থেকে স্বাগতা ভালোবাসতো কিন্তু স্বাগতা শৈবালকে এড়িয়ে চলতো। শৈবাল কোনদিনও মুখফুটে স্বাগতাকে বলেনি যে ও স্বাগতাকে ভালোবাসতো কিনতু আমরা সক্কলে একথা জানতাম। স্বাগতার কথায় আমরা তিনজনেই চমকে উঠলাম। আমি প্রায় চিৎকার করেই বললাম “তুই ম্যারেড ভুলে গেলি নাকি”। ও খুব শান্ত আর দৃঢ় স্বরে বলল “কিচ্ছু ভুলিনি। কাউকে যদি আমি ভালোবাসি তার মানে কি আমি আমার স্বামীকে চিট্ করছি! আমি যদি শৈবালকে ভালোবাসি, ওর সাথে ফোনে কথা বলি,চ্যাট করি তাহলে কি আমার স্বামীকে চিট্ করা হয়! লালি, আমি তোকেও খুব ভালোবাসি। তার মানে কি আমি আমার স্বামীকে চিট করছি?” নীলের তখনও বিষ্ময় কাটেনি,বলল,“কিন্তু এ কেমন ভালোবাসা!” স্বাগতা যেন এক বিদ্রোহী। একটানে সমস্ত নিয়মকানুন উলোটপালট করে দেবে,বলল,“কেন! ভালোবাসা মানেই কি শরীর ছুঁয়ে থাকতে হবে মন ছুঁয়ে কি থাকা যায়না? ভালোবাসা মানেই কি বিয়ে করে সংসার পাততে হবে? ভালোবাসা একটা অনুভুতি। আমার স্বামী আছে বলে সে অনুভুতি কখনই হবে না এরকম তো কথা কখনই থাকতে পারেনা! নীল,লালি বিবাহিত জেনে কি তোর কি লালিরষপ্রতি ভালোবাসা শেষ হয়ে গেছে নাকি লালি বিবাহিত বলে তোকে এখনও ভালোবাসেনা?” এই কথাটারষজন্য আমরা দুজনেই প্রস্তুত ছিলাম না। নীল বলে উঠলো “বাজে কথা রাখ”। স্বাগতা হেসে বলল,“ বাজে কথা!  তুই তো দিব্যি-টিব্যি মানিস না তাহলে আজ লালির দিব্যি মেনে এলি কেন? আর লালিই বা কিসের জোরে বলল ‘নীল আসবেই’,যেখানে আমরা সবাই জানি তোর সাথে শৈবালের মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিল!”

আমরা উঠে পরলাম।  আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছিল। শৈবালের হারিয়ে যাওয়া সবকিছু  আমি ওর জীবনের শেষ সময়ে ফিরিয়ে দিতে পেরেছি। আমাদের জীবনে হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা বন্ধুত্ব ফিরে এল কিনা জানি না কিন্তু শৈবালকে দিতে পেরে আমরা সকলেই অনাবিল আনন্দের অধিকারী হলাম। 

No comments:

Post a Comment