সকালবেলা রানুদির বকবকানির ঠ্যালায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। কাল অনেক রাত অবদি নীচের ঘরে দাদুর সাথে জেগেছিলাম। দাদুর কাছে মোটা লাল ভেলভেটের হলুদ হয়ে যাওয়া একটা বই আছে। বইটা লাল সাটিনের দড়ি দিয়ে বাঁধা। বইটা আসলে ছিল দাদুর নিজের দাদুর। উনি দাদুকে মৃত্যুর আগে বইটা দিয়ে যান। বইটা দেবার সাতদিন বাদে উনি মারা যান অদ্ভুত ভাবে। অদ্ভুত এইকারনে কারণ উনি দাদুকে বইটা দেবার সময় বলেছিলেন,“আমি বইটা খুলে পরেছি,আর সাতদিন বাদে আমি মরবো। এইবইটা তুমি রাখ। কখ্খনও খুলে পড়বেনা। তাহলে তুমিও মরবে”। বইটার মধ্যে এক একটা অধ্যায়ে এক একটা হত্যাকাণ্ড আছে। দাদুর বক্তব্য অনুযায়ী যে হত্যাকাণ্ডটি পরা হবে সেটিই নাকি ঘটবে। আর ঐ বইটা খুললে নাকি যার তত্ত্ববধানে ঐ বইটা থাকবে সে বই খোলার সাতদিন বাদে মারা যাবে। যত্তসব বুজরুকি! আমি মানিনি কাল রাতে চুপি চুপি দাদুর বইয়ের তাক থেকে বইটা নামিয়ে আমার ঘরে নিয়ে এসেছি। কাল অনেক রাত জেগে একটা গল্প পড়েছি। বেশ ইন্টারেস্টিং। শেষ করতে করতে ভোর হয়ে গেছে।
তবে গল্পটা অনেকটা ব্যোমকেশ বক্সীর একটা গল্পের মত।গল্পটা হল এই রকম, এক মধ্যবয়স্ক লোক তার একতলার লাইব্রেরীতে পড়াশোনা করতে করতে মারা যান। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল মানে নাইটল্যাচ লাগানো যেটা বাইরে থেকে টেনে দিলে লেগে যায়। চাবি ছাড়া বাইরে থেকে খোলা যায়না। প্রাথমিক তদন্তে মনে হয়, চাকর দুধ দিয়ে গিয়েছিল, সেই দুধ খেয়ে বিষক্রিয়া হয়ে মারা যায়। চাকরকে গ্রেপ্তার করাহয়। কিন্তু পোষ্টমর্টেমের পর দেখা যায় বডির ডান ঘাড়ে একটা ছোট্ট আলপিন আমূল গেঁথে রয়েছে। বিষ ঐ পিনের আগাতেই ছিল এবং দুধে কোনও বিষের ট্রেস পাওয়া যায়নি। তদন্তে জানা যায় ভিকটিমের খুরতুতো ভাই বহুদিন বাদে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ফিরেছিল। ওখানকারই এক ট্রাইবাল গোষ্ঠীপতির কাছ থেকে ব্লোপাইপের ব্যবহার শেখে আর সেই প্রসেস অ্যাপলাই করে জানলার বাইরে থেকে বিষ পিন দিয়ে খুন করে।
আর ঘুম হলোনা। আজ রবিবার ব্রেকফাস্ট টেবিলে লুচি আলুরদম পরিবেশন করতে করতে মা বলল, “শান্তর বাবা কাল রাতে মারা গেছেন। এইতো ছেলেটা এল গত পরশু। বাবার সাথে কাটাতেও পারলোনা”
আমি জিগ্গেস করলাম,“কি হয়েছিল কাকুর। হার্ট অ্যাটাক?”
— “আরে না সেটাই তো আশ্চর্যের। এতদিনের বিশ্বস্ত চাকর বৃন্দাবন,সে কিনা মনিবকে মারল দুধে বিষ মিশিয়ে!কি দিনকাল পরেছে কাউকে বিশ্বাস করা যায়না!” মা বকবক করতে করতে রান্নাঘরে চলে গেল। কিন্তু আমি যেন মুখে লুচি নিয়ে চিবাতে ভুলে গেছি। তাহলে কি দাদু ঠিকই বলেছিল। এখন আমি কিকরি। নিজের মাথাটা দেয়ালে ঠুকতে ইচ্ছা করছিল। কোনওরকমে খাওয়া শেষ করে দৌড়ে গেলাম ঘরে প্রতিম কে ফোন করতে। ওর বুদ্ধিটা দৌড়ায় বেশী।ব্যাটা আবার ফোনটা অফ করে বসে আছে । বাইরে যাবার কথা ছিল হয়তো তাই গেছে। প্রতিম ফিরতে ফিরতে তিনদিন কেটে গেল। আর এই তিন দিনে পোষ্টমর্টেম হয়ে এটাও বেরিয়ে গেল যে খুন বৃন্দাবন করেনি। যদিও সাসপেক্ট সে রয়েই যাচ্ছে। কারন দুধ দেওয়ার বহু পরে মৃত্যুর টাইম বেরিয়েছে পোষ্টমর্টেমে এবং ঘাড়ে বিষমাখানো পিন পাওয়া যায়। তাতেকি! বৃন্দাবন তো পরেও কার্য সিদ্ধি করতে পারে!আর যদি বৃন্দাবন না করে তাহলে কে করলো খুনটা। আমার বুক ধড়াসধড়াস করছে সব সময়। আমি জানি খুনটা করেছে শান্তদা, অন্ততঃ গল্প তো তাই বলছে। এদিকে দাদুরও হঠাৎ শারিরীক অবনতি শুরুহয়েছে। আমি কি করি দিশেহারা এর মাঝে প্রতিম বাইরে থেকে ফিরলো।
প্রতিমকে সব ঘটনা বলে আমার খানিকটা হালকা লাগলেও নতুন চিন্তা ঢুকলো বইটা খোলার জন্য কি শেষে দাদুর মৃত্যুর জন্য দায়ী হবো! প্রতিম চিন্তিত হয়ে ভাবছিল।
হঠাৎ বলে উঠলো,“আমার মাথায় এলনা দাদু বইটা এতদিন ধরে নিয়ে রাখল কেন”
ওর কথা শুনে আমার পিত্তি জ্বলে গেল,আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,“তাহলে কি করতো?”
—“কেন!পুড়িয়ে ফেলতো!” ওর কথায় আমিও আশ্চয্য হয়ে গেলাম। সত্যিই তো বই টা পুড়িয়ে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যেত। আমরা ঠিক করলাম পরেরদিন প্রতিম দের ছাদে ওর মা বাবা অফিস চলে গেলে বইটা পুড়িয়ে ফেলব। এর মাঝে পুলিশ এসে শান্তদাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল। মা আবার ‘সন্তান’ ‘বুকের রক্ত জল করে মানুষ করা’ এই সব সেন্টিমেন্টাল কথা ব্যবহার করে সারাদিন বকবক করে গেল। আমি ভয়ে আর দাদুর ঘরে যাইনি,যদি দাদু বইটার কথা জিগ্গেস করে!
বইটাকে পুড়িয়ে ভীষণ হালকা লাগছিল। দাদুও অপেক্ষাকৃত সুস্থ। দাদুর চোখে প্রতিম এখন হিরো। বাড়ীর লোক জানলোওনা কি হয়ে গেল কিন্তু আমার এখনও মনে হয় পুরোটাই কাকতালীয় আর কুসংস্কার।
No comments:
Post a Comment