অনেক বছর আগের কথা,বলতে গেলে আমাদের মা বাবাদের ছোটবেলা। ক্ষীরোদ দত্ত আদ্রা রেলে চাকরি করতেন। তিনটি ছেলে ও একটি মেয়ে আর স্ত্রী রাধাকে নিয়ে সংসার। যেটুকু আয় তার পুরোটাই চলে যেত সংসারে,কিছু জমানো তো দূরে থাক রাধাকে একটা ঠিকে কাজের লোকের সুখও দিতে পারেন নি ক্ষীরোদ। এই অভাবের সংসারে এসে পড়ল মা-বাপ মরা বোনের মেয়ে রত্না। রাধার বিরক্তি ছিল অনেক কারন পাঁচজনের মুখে ভাত যোগান দিতে দিতেই হত দরিদ্র এর মধ্যে আবার আর একজন! শুরু হল রত্নাকে দিয়ে যাবতীয় কাজ করানো। রত্না মুখবুজে সব করত। ক্ষীরোদের বড় ছেলে যতিনের বোঝার বয়স হয়েছিল। রত্নাকে এইভাবে খাটতে দেখে তার কষ্ট হত কিন্তু রাধার মুখের ওপর কথা বলার সাহস তো ক্ষীরোদেরই হতনা তো যতিন বলে কিকরে। রাধা ইচ্ছাকরে রত্নাকে কম খেতে দিত যাতে রত্না আর একটু চায় আর রাধা মনের সুখে বকাবকি করবে। কিনতু রত্না সে সুযোগ দিতনা হে আর ভাত চাইত না। রাধা পরেরদিন আরও কম দিত কিন্তু রত্না কীছুতেই চাইতনা। এইভাবে চলতে চলতে একদিন রত্না পালিয়ে গেল। খোঁজ নিয়ে জানা গেল একটি ছেলের সাথে সে চলে গেছে। ক্ষীরোদের মন মানতে চাইল না। রত্নাকে সে বাড়ী ফিরিয়ে আনতে চাইল কিন্তু রাধা তার নিজের মেয়ের ভবিষ্যতের দোহাই দিয়ে ক্ষীরোদকে বাধা দিল। ক্ষীরোদ কিনতু ভুলতে পারলনা রত্নার কথা। একটা অপরাধবোধ কাজ করত সবসময়।
এরপর বহুবছর কেটে গেছে। যতিনের মেয়ে তখন যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পরাশোনা করে। একদিন চুপিচুপি ক্ষীরোদ তাকে ডাকলো। বলল,আমার একটা কাজ করে দিবি? নিজের ডাইরির পাতার ফাঁক থেকে একটা হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজ বার করে বলল, একে একটু আমার কাছে নিয়ে আসবি? যতিনের মেয়ে রিনি অনেক কষ্টে সেই লেখা পাঠোদ্ধার করে বুঝলো সেটা যাদবপুরের ঠিকানা। যার ঠিকানা তার নাম রত্নাসেন। রিনি ঠিকানা অনুযায়ী গিয়ে দেখলো সেখানে সে ঠিকানার অস্তিত্বই নেই! কিকরা যায়। ছোটবেলা থেকে এই রত্না নামের ভদ্রমহিলার কথা এত শুনেছে যে জেদ চেপে গেল। এবার নাম ধরে খুঁজতে শুরু করল। একদিন একজন সৌম্যকান্তি ভ্দ্রলোক জিগ্গেস করলেন, এই মহিলা আপনার কে হন। রিনি বলল,উনি আমার পিসি। ভদ্রলোক অনেকক্ষণ রিনির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে জিগ্গেস করলেন, তুমি কি যতিনের মেয়ে? এস আমার সাথে। ভদ্রলোক একটা দামী গাড়ীতে উঠলেন। রিনির মনে এখন একটাই প্রশ্ন ইনিই কি সেই হিরো যে পিসিকে রক্ষা করেছিলেন!ভদ্রলোক গাড়িতেই একজনকে ফোন করলেন, তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। তুমি ভাবতে থাকো আমি নিয়ে আসছি। গাড়ী এসে দাঁড়ালো একটা সুন্দর তিনতলা বাড়ীর সামনে। দরজা খুলে বেড়লেন এক হাস্যময়ী ঝকঝকে প্রৌঢ়া। রিনিকে দেখে থমকে গেলেন। স্বামীকে জিগ্গেস করলেন ,কে ও? স্বামী মিটিমিটি হেসে বললেন, বলতো কে? তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে এসেছে আমারই কাছে! চিনতে পারলেনা তো! তোমার ভাই যতিনের মেয়ে গো! রিনি ততক্ষণে ঢিপ করে প্রণাম করে ফেলেছে। রত্না ছলছলে চোখে জড়িয়ে ধরলো। তারপর চলল খাওয়া দাওয়া। একেএকে সবার খোজ নিলো রত্না। যাবার সময় রিনি বলল,পিসি দাদু তোমার জন্য খুব মন খারাপ করে তুমি একবারটি চলো। রত্না সস্নেহে রিনির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,নারে সোনা আমি যাবনা। আমি গিয়ে সামনে দাঁড়ালে মামার অপরাধ বোধ আরও বাড়বে। এই বুড়ো বয়সে আমি ওনাকে আর কষ্ট দিতে চাইনা। তুই আমার একটা কাজ করবি সোনা?আমার সাথে তোর যে দেখা হয়েছে একথা মামাকে বলিসনা। মামা জানুক যে আমি হারিয়ে গেছি। রিনি ওর মানিব্যাগ খুলে দাদুর ছবিটা রত্নার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,নাইবা গেল ভাগনি মামার কাছে। মামা তো এল!
No comments:
Post a Comment