Monday, 24 October 2016

কুকুর-কাহিনী

প্রত্যেক পাড়ায় একটা-দুটো শুটকো ছেলে থাকে যারা পাড়ার মা-বোনেদের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নেয়। উটকো ছেলে পাড়ায় ঢুকলে সরু লিকপিকে চেহারা নিয়ে এগিয়ে গিয়ে বিশাল বড় বড় বাতেল্লা ঝারে। কিন্তু প্রতিপক্ষ একবার চোখ কুচকালেই কিন্তু প্রাণপাখি ডানা মেলে।

আমাদের পাড়ার ঠিক এইরকম দুটি চ্যাংরা কুকুর আছে। কুকুর মানে কিন্তু আমি চতুস্পদ প্রাণী ‘ডগ’এর কথাই বলছি। একটা কালো একটা সাদা। চ্যাংরা এইকারনেই বলছি, পাড়ার মুদিদোকান থেকে বেড়োলেই পিছন পিছন হাটতে থাকবে যতক্ষন না বাড়ীর গেট খুলে ঢুকি। বারান্দায় দাঁড়ালে হাঁ করে উপর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।

কোনও কুকুর যদি পাড়া দিয়ে ‘পাস’ করে তো শুরু হয়ে যাবে ওর ঘৌঘৌ। আর একবার যদি শুরু করলো তো যতক্ষণ না লাঠি নিয়ে তেড়ে যাব ততক্ষণ ঘৌঘৌ করেই যাবে। একদিন মাঝরাতে ঠিক আমরই জানলার নীচে শুরু করেছে ওর পোঁ। কিছুতেই আর থামেনা, একঘন্টার ওপর হয়ে গেছে ঘৌঘৌ করেই চলেছে। বাবুই রেগেমেগে খাটে উঠে বসে বলল,“মনে হচ্ছে ওর পিছনে ক্যাৎ করে এক লাথ মারি”। আমি আর বাবুই নীচে লাঠি নিয়ে নেমে এলাম। লাঠি দেখে চোঁ চাঁ দৌড় দিয়ে পগাড় পার। মনে মনে বললাম ‘বাঁচা গেল’। বেশ কিছুদিন চুপচাপ।

দিন পনেরো বাদে আবার রাত্রিবেলা এক কিস্সা। কিছুক্ষণ  চলার পর পাশ থেকে বাবুইয়ের বিরক্তিসূচক  নানা আওয়াজ কানে আসতে লাগলো। উঠে বারান্দায় গিয়ে দেখি কেউ কোথ্থাও নেই।  ওটা বারান্দার নীচে দাঁড়িয়ে ডেকেই চলেছে। আমি ঘরে এলাম এক বালতি জল উপর থেকে দিলাম ফেলে। বেশীরভাগ টাই পড়লো রাস্তায়। গরমকাল ছিল বলেই জল থেরাপি কাজে লাগাতে পেরেছি। যাইহোক সে ছত্রভঙ্গ হয়ে পালালো।

এখন ওর ঘৌঘৌয়ের ব্যামো চাপলে আমি বারান্দায় গিয়ে দাড়াই। কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে ‘ভোক-ভোক’ করে তারপর আস্তে আস্তে চলে যায়।

ছোটবেলা থেকে আমি কুকুরকে খুব ভয় পেতাম। কিন্তু দেখা গেল আমার যে বাড়ীতে বিয়ে ঠিক হল সে বাড়ীর অন্যতম মেম্বার একটি জার্মান স্পিৎজ। শুনলাম কুকুরটি আমার সদ্য গত হওয়া হবু শ্বাশুরি মায়ের খুব কাছের। শ্বাশুরি মা চলে যাবার পর সে এখন আমার হবু স্বামী মানে রাজার খুব কাছের। ক্রমশ আমার বিয়ের দিন এগিয়ে আসতে লাগল আর আমার আতঙ্ক বাড়তে লাগল। এইসবের মধ্যে আমার বিয়েও হয়ে গেল। বিয়ের পরের দিন যখন শ্বশুর বাড়ী গেলাম,সমস্ত আচার অনুস্ঠানের পর আমার শ্বশুরমশাই কুকুরটিকে আমার সাথে আলাপ করাতে নিয়ে এলেন। তখন জানলাম ওর নাম ‘ভিকি’। ভিকি আমায় শুঁকলো,পায়ের আঙ্গুল চাটলো চলে গেল। আমি জানিনা ভিকি আমাকে কিভাবে নিল কিন্তু আমি ওর সামনে রাজাকে ছুঁতাম না,এই ভয়ে যে ও যদি রিঅ্যাকট করে! ভিকি কিন্তু সব সময় আমার পিছন পিছন ঘুরতো। আমি খেতে বসলে ও চেয়ারের তলায় বসে থাকত আমি শুতে গেলে আমার খাটের তলায় শুয়ে থাকতো। আমার শ্বশুর মশাইয়ের সংগে আমার বিভিন্ন কারনে বাগবিতণ্ডা হত। উনি আক্রমনাত্মক হলেই ভিকি তেড়ে যেত। এরপর এমন হল উনি আমার কাছাকাছি থাকলেই ভিকি তেড়ে যেত। একবার দুপুরে হঠাৎ  কালবৈশাখী ঝড় উঠল। প্রবল বাজ পড়ছিল।ঘুম একটু হালকা হতেই টের পেলাম ভিকি আমার কোমড়ে ঠেস দিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। সেই প্রথম ওকে আমি বিছানায় উঠতে দেখেছিলাম। এইভাবে ওর সাথে আমার সখ্যতা হয়েগিয়েছিল। আমি কম্পিউটার  ইন্সটিটিউট যেতাম। বিকেলে ফিরে দেখতাম ও আমার জন্য বারান্দায় অপেক্ষা করছে। ও নাকি ঠিক আমার আসার সময় হলেই বারান্দায় গিয়ে বসে থাকত। এইভাবে দুবছর চলল। একদিন সকাল ঘুম থেকে উঠে দেখি ও খুব কাঁপছে। সময়টা ছিল জানুয়ারি মাস ৮তারিখ।  আমি রাজাকে ডেকে তুললাম। রাজা ঘুম থেকে উঠলে ও যে ভাবে রিঅ্যাকট করতো তার কিছুই করল না। সেদিন রবিবার ছিল তাই রাজা আডডা দিতে চলে গেল। যাবার আগে ওকে ছাদে বিছানা পেতে হালকা রোদে শুইয়ে রেখে গেল। আমি বসেরইলাম সামনে যদি ও জল-টল কিছু চায়। ছাদৈ কাক বসলে ও তেড়ে যেত সেদিন কাকে ওর ল্যাজ টানছিল পা টানছিল ও কিচ্ছু বলছিল না। বঝতে পারছিলাম ওর সময় আগত। আমি কাকগুলো তাড়িয়ে রাজাকে ফোন করলাম, তুমি শিগগিরি এসো আমার ভালো ঠেকছেনা। রাজা একটু পরেই দৌড়তে দৌড়তে এল। ছাদে এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল“কি হয়েছে মা,কষ্ট হচ্ছে?” কথা শেষ হতেই ভিকি রাজার হাতের কড়ে আঙ্গুলটা হালকা করে মুখে নিল। কিন্তু দাঁত চেপে বসল রাজার আঙ্গুলে। ভিকি আর নেই! যেই রাজাকে ও কারও সাথে সেয়ার করতে চাইত না, যার কাছে ও দুবেলা খেত,খুনসুটি করত, তার কাছ থেকে শেষ বিদায় টা নিয়েই ভিকি চলে গেল।

No comments:

Post a Comment