Monday, 29 October 2018

প্রেম ~১০ম পর্ব

তমাল বিদেশে গেছে আজ নয় বছর হয়ে গেছে। বিদেশে যাবার পর ও আর কারও সাথে যোগাযোগ রাখেনি মাটিও চেষ্টা করেনি। সে এখন নামকরা সাইকলজিস্ট। একটি নামী বেসরকারি হসপিটালে কর্মরতা। চোখে উঠেছে হাল্কা পাওয়ারের চশমা। শোভা বিয়ে করে ঘোর সংসারী কিন্তু প্রতি রবিবার ফোন করে মাটির খবর নিতে তার কখনো ভুল হয়না। প্রবাল কলেজের একটি মেয়েকেই বিয়ে করেছিল। কিন্তু ওর মায়ের মানষিক
অত্যাচারে মেয়েটি এখন আধা মানষিক রোগী। চিকিৎসা চলছে মাটির কাছেই।

আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরবে ঠিক করেছে মাটি। কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই, তাছাড়া শরীরটাও ভালো লাগছে না। ঘড়িটা দেখে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে দরজা ঠেলে ঢুকলো একজন সুবেশ তরুন। চোখের রিমলেস চশমাটি ঠিক করতে করতে বললেন, ''সরি, অ্যাটেনডেন্ট আটকেছিলেন কিন্তু আমার দেখা করাটা জরুরী ছিল।" কথা বলার কায়দা দেখে বলে দিতে হয়না তরুনটি 'কে'। অ্যাটেনডেন্ট কাচুমাচু মুখে দরজা খুলে উঁকি মারলো, মাটি ইসারায় ওকে যেতে বলল। এবার তরুনটির দিকে তাকিয়ে বল্ল, "ইয়েস, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ? অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া আমি পেসেন্ট দেখিনা, আপনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসুন"
"মাটি প্লিজ" চাপা গলায় ধমকে উঠলো তরুনটি।
"এখানে আমার নাম ধরে কেউ সম্বধন করে না"মাটি গম্ভির গলায় বল্ল।
" সবার আর আমার মধ্যে পার্থক্য আছে।আমি তোমাকে যেকোন জায়গায় যেকোন সময়ে  এই সম্বোধন করতে পারি। কেউ আমায় বাধা দিতে পারবেনা" তরুনটি বলে।
"এতদিন বাদে নিজের অধিকার ফলাতে এসেছো, কে হে তুমি।" মাটির মন্তব্যের উত্তরে তরুনটি বলে," আমি সেই তমাল, যে তোমাকে সময়ের হাতে গচ্ছিত রেখে গিয়েছিলাম"
"বিদেশে কি বাংলা নিয়ে পরছিলে নাকি!" মাটি টেবিল গোছাতে গোছাতে বল্ল।
"নাহ তবে বিদেশে তোমাকে ছাড়া থাকতে থাকতে...."
মাটি মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বল্ল, "কি কাজে এসেছ বলো। আমার তাড়া আছে, বেড়বো"

বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে তমাল বল্ল," তুমি আমায় কথা দিয়েছিলে আমার মানষিকতা বদলালেও তোমার বদলাবেনা!"
"বদলায় নি তো!"
"আমিও বদলাই নি। এই কয় বছর আমি শুধু তোমার কথাই ভেবেছি, কবে ফিরবো তার দিন গুনেছি।" মাটি কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তমাল টেবিলের ওপর তার বাড়িয়ে রাখা হাতে হালকা চাপ দিয়ে বলল, "অনেক তো হলো একা চলা এবার তোমার এই হাতটা ধরে তোমার সাথে পা মিলিয়ে চলতে দাও" তমাল চুপ করলো মাটিও চুপ। কিছুক্ষন থেমে তমাল আবার বলল, "চলবে তুমি সারাটা জীবন একসাথে, একছাদের তলায়, একইবন্ধনে?" মাটি মুখে আর কিছু বলতে পারলোনা, শুধু বাষ্পসিক্ত গলায় বলল,"পারব"।

সমাপ্ত







Thursday, 25 October 2018

প্রেম~৯ম

মাটি কলেজ আসে সবার আগে। তখন সবে মাত্র অনিল কাকা কলাপসিবল খুলে ক্লাসরুমগুলোর তালা খোলে। আজ কোলাপসিবলের সামনে তমাল কে দেখে মাটি একটু অবাকই হলো। আজকের দিনটা একটু অন্যরকম কারন আজ সকাল থেকে বৃষ্টি হয়েই চলেছে।মাটি আজ এসেছে লাইব্রেরিতে একটা কাজ আছে তাই নইলে ও-ও আজ আসতো না। আজকের দিনটা বাড়ীতে বসে খিচুড়ি খাবার দিন।
মাটি ছাতা বন্ধ করে ব্যাগ থেকে প্লাস্টিক বার করে তার মধ্যে রাখলো। ততক্ষন পর্যন্ত তমাল মাটি কে জরিপ করছিলো। মাটি ক্লাসের দিকে পা বাড়াতেই তমাল রাস্তা আগলে দাঁড়ালো, "তোমার সাথে কথা আছে"
খুব নির্লিপ্ত ভাবে মাটি বলল, "আমার আপনার সাথে কোনও কথা নেই"
তমাল কে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই মাটি ক্লাসের দিকে চলে যায়। হতবুদ্ধি তমাল দাঁড়িয়ে থাকে। সারাদিনে বহুবার তমাল চেষ্টা করে মাটির সাথে কথা বলতে কিন্তু প্রতিবারই মাটি তমালের চেষ্টায় ছাই ফেলে চলে যায়।
    আজ শোভা আসেনি। প্রথমে ভেবেছিল পরের ক্লাসগুলো না করে চলে যাবে মাটি। সারাদিন অবিশ্রান্ত ধারায় হয়েই চলেছে বৃষ্টি। হাতে গোনা স্টুডেন্ট এসেছে। টিচারাও এসেছে কম। কিন্তু পরে ভাবলো বাড়ি গিয়েই বা কি হবে, আধা দিন তো পেরিয়েই গেছে। ইম্পরট্যান্ট কিছু লেখার ছিলো তাই লাইব্রেরিতে গিয়েই বসলো।বেশ কিছুক্ষন পর মনে হলো কেউ পাশে বসলো। খানিক পর একটা স্লিপ এল, 'প্লিজ আমার কথাটা শুনে, তারপর ডিসিশন নাও'। মাটি উঠে পড়লো। বইটা জমা দিয়ে বেড়িয়ে এল। অনুভব করলো পিছনে তমালও আসছে। মাটি ক্যান্টিনে গিয়ে বসলো। চারটে বেজে গেছে তাই ক্যান্টিনে ফুড কাউন্টার বন্ধ হয়ে গেছে। চেয়ার গুলো উলটে টেবিলের ওপর তোলা ছিলো, তারই একটা নামিয়ে মাটি বসলো। তমাল সামনে এসে বসতেই মাটি বলল,"কেন এই ভাবে আমাকে বিরক্ত করছেন আপনি?"
"আপনি!!আপনি বলছো তুমি আমায়!" আহত তমাল বলে ওঠে।
"কেন, এই সম্বোধন তো নতুন নয় আপনার কাছে। বরং তুমি টাই নতুন ছিলো। 'তুমি' তো কাছের মানুষদের বলে তাই না?"
"তুমি কি আমায় কাছের মানুষ মনে করোনা?" তমাল অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
"আমার মনে করাতে কি আসে যায়। আপনি যে মনে করেন না সেটা তো প্রমানিত।" মাটি দৃঢ় জবাব দেয়।"গত কদিনের ঘটনা কি সেই প্রমান দেয় না?"
"তোমার কি মনে হয় তুমি আমার কাছের নও"
"নই'ই তো"
"আমি তোমাকে ভালোবাসি, সেটাও কি তুমি বোঝনা" নিরুপায় দেওয়ালে পিঠ থেকে যাওয়া আহত এক মানুষের মতো বলে ওঠে তমাল।
"এখন আর এসব কথার কোনো মুল্যই নেই" মাটি উঠে দাঁড়িয়ে চেয়ার  টেবিলের নিচে ঠেলে দিতেই তমালের মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট আওয়াজ বেড়লো। মাটি দরজার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল পিছন ঘুরে তমালএর অবস্থা দেখতে গিয়ে দেখে তমাল হাঁটু চেপে ধরে বসে আসে, চোখ দিয়ে জল পরছে। মাটি যখন চেয়ারটা ঠেলে দিয়েছিলো সেটা গিয়ে লেগেছিলো তমালের চোট লাগা পায়ে, যেটা এখনো ঠিক মতো সাড়েনি। মাটি ছুটে এসে তমালের পায়ের কাছে বসে পড়লো
"কোথায় লেগেছে তোমার" মাটি ব্যস্ত হয়ে বলে "এই জন্য আমি বলেছিলাম তোমাকে বাড়িতেই থাকতে। আমার কথা কে শোনে"
"তাহলে মানছো তো আমি তোমার কাছের মানুষ" তমালের কথায় মাটি থমকে গেল, "উঠে বসো" তমাল হুকুমের স্বরে বলল। কিছুক্ষন দুজনেই চুপ, শুধু বাইরে বৃষ্টির অবিশ্রান্ত আওয়াজ।

"তোমায় ভালোবাসি বলেই অভিমান করেছিলাম। আর তাই......" নিরবতা ভাঙলো তমাল, "তুমি ভুল বুঝোনা আমায়। আমার মনে হয়েছিল তুমি তোমার স্বার্থের জন্যই আমার সাথে ছটাদিন নার্সিংহোম ছিলে"
"স্বার্থ তো আমার ছিলোই। তোমার ওই রকম অবস্থা দেখে আমার যে কি হচ্ছিলো তুমি বুঝবেনা। সহেলী আমায় বলেছিলো আমি তোমার কাছাকাছি গেলে ও আমার ক্ষতি করবে। সে ক্ষতি যে এমন সেতো আমি বুঝিনি।" এটুকু বলে মাটি থামলো।
"আমি বাইরে চলে যাচ্ছি" ব্যথিত গলায় তমাল বলল।
"আমি জানি" মাটি দীর্ঘশ্বাস লুকালো।
"ওখানে যাবার আগে আমি তোমার বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসতে চাই" গম্ভীর ও দৃঢ় গলায় বলে তমাল।
"না, কোনো সিদ্ধান্ত নেবার সময় এখনো হয়নি।আমি আমার টার্গেট আচিভ করি। ততদিন যদি তোমার একই মানষিক অবস্থা থাকে তখন সিদ্ধান্ত নিও আমি বাঁধা দেব না" নীচু গলায় বলল মাটি।
"ততদিনে যদি আমার মানষিকতা বদলে যায়"
মাটি স্মিত  হেসে বলল, " আমার মানষিকতা একই থাকবে"
তমাল অপলকে কিছুক্ষন তাকিয়ে বলল, "পাগলী"








Tuesday, 23 October 2018

প্রেম~৮ম

আজ একমাস পর তমাল কলেজে ঢুকলো। ক্যাম্পাসের গেট পেরনোর সাথে সাথে সকলেই তমালএর কুশল জিজ্ঞেস করছিল। তমাল খুঁজছিল আর একজন কে প্রতিদিন সে দুবার করে ফোন করেছে কিন্তু কোনও বারই তমাল তোলেনি। জানে যে প্রবালের কাছ থেকে নিয়মিত খবর নিয়েছে। কলেজের কোলাপসিবল পেরতেই সামনে মাটি, "কেমন? আছেন" তমাল কে দেখে মাটি উছ্বসিত। নির্লিপ্তভাবে উত্তর দেয় তমাল, "যেমন দেখছেন।" মাটি একটু দমে যায় তমালের এই উত্তর সে আশা করে নি। তমাল একটু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, "কি দরকার?আপনি তো নিজের প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথাই কাউকে বলেন না!" মাটি যে এই ধরনের কথা আশা করেনি সে তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। অপ্রস্তুত সে একবার তমালের দিকে একবার শোভার দিকে তাকিয়ে ক্লাসের দিকে এগিয়ে গেল। শোভা তমালের এই ব্যবহারে বিস্মিত। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সেও পিছু নিল মাটির। তমাল এতটা রুঢ় হয়ে মনে মনে কষ্টই পেলো। কি দরকার ছিল এমনভাবে বলার, না বললেই ভালো হতো! নিজের ব্যবহারে নিজেরই মেজাজটা খিঁচরে গেল। নিজের অজান্তেই একবার চারিদিক তাকালো।

 মাটির কথাতেই প্রবাল সহেলীর পিছনে ছেলে লাগিয়েছিল। তিনদিনের মাথায় কলেজের একটি ছেলে সহেলীর সাথে দেখা করে টাকা চাইতে আসে। প্রবালের ছেলেদের চাপে পরে ছেলেটি স্বীকার করে যে টাকার বিনিময়ে তমালের উপর চড়াও হয়েছিলো। আর সেই টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আর কেউ নয় স্বয়ং সহেলী। সব কিছু জানাজানির পর সহেলী কলেজ ছেড়ে চলে গেছে।
তমালের এই দুর্ঘটনার পর তমালের বাবা আর ছেলেকে এখানে রাখতে নারাজ। তমালের জ্যাঠা আর দাদু আমেরিকা থাকে। তাই তমালকেও সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাকি পড়াশোনা সেখানেই হবে।এইজন্যও মনটা বিক্ষিপ্ত ছিল। মাটির ওপর রাগটা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।কারনে অকারনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে মাটিকে অপদস্থ করতে শুরু করলো তমাল। তমাল চাইছিলো একবার মাটি প্রতিবাদ করুক। কিন্ত মাটি যেন পাষাণ হয়ে গেছে কোনো উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে ছলে গেছে প্রতিবার।
          দিন সাতেক পর একদিন কলেজের সবাই চলে গেছে। তমাল বেরিয়ে খানিকটা হাটার পর রাস্তা আগলে দাঁড়িয়ে শোভা, "আপনার সাথে একটু কথা ছিলো, সময় হবে?" কাছেই একটা স্ল্যাব ছিলো। সেখানে গিয়েই তমাল বসলো। এখনও বেশিক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি সে আয়ত্ব করতে পারেনি। প্রথম কথা শোভাই শুরু করলো,"আপনি বিদেশে যাবার আগে মাটির সাথে রিলেশন টা ঠিক করে নিন"
"আমাদের মধ্যে কোনও বিশেষ রিলেশন নেই যা ঠিক করার দরকার আছে" জেদি ঘোড়ার মতো বল্ল তমাল।
"তাই নাকি! তাহলে সকলের সামনে 'আপনি' টা নিজেদের মধ্যে 'তুমি' হয়ে যায় কেনো?! কি লুকাতে চান বিশ্ব সংসারের কাছে? আড়াল থেকে কেনো দেখেন মাটিকে?" তমাল মাথা নীচু করে চুপ করে বসে আছে হেরে যাওয়া জুয়ারির মত।
"আপনি যদি মনে করেন আপনার দেওয়া এই মানষিক চাপের ও প্রতিবাদ করবে, তাহলে আপনি ভুল ভাবছেন। ও কোনদিনই তা করবে না কারন নিজেকে দোষী  মনে করে" শোভা একটু থামতেই তমাল যেন জেগে ওঠে,"দোষী কি ও নয়!! চার-চারটা দিন ও আমার সাথে অভিনয় করে গেছে!! নিজের স্বার্থটুকু ছাড়া ও কোনদিন কি বুঝেছে?"
তমালের অবুঝ শিশুমনকে বোঝাতে গিয়ে শোভার গলা নরম হয়ে গেল, " ও অভিনয় করেনি। আপনি ওর যেটুকু দেখেছিলেন সেটুকুই আসল, আমরা যেটা দেখি সেটা তো একটা মুখোশ। আপনি ওর বিশেষ কেউ বলেই তো ও তদন্ত টা করেছিলো। কলেজে তো কত কিছু হচ্ছে সেখানে তো ও নাক গলায়নি।আর স্বার্থের কথা বলছেন? আজ পর্যন্ত কি চেয়েছে আর কি নিয়েছে ও আপনার কাছ থেকে।" তমাল চুপ। একটু থেমে শোভা আবার শুরু করলো,"ও তখন ক্লাস নাইনে পরে। ওর বাবার একটা খুব বড়ো দুর্ঘটনার শিকার হন, যার ফলে ওনার একটা চোখ নষ্ট হয়ে যায়। উনি খুব বড় একটা চাকরি করতেন সেটাও খোয়াতে হয়। তখন খুব খারাপ অবস্থা হয়েছিলো ওদের। তারপর ওর বাবা একটা ছোটখাটো চাকরি পান আর ওর মা সমস্ত গয়না বিক্রি করে একটা বুটিক খোলেন। এসব কথা ও কখনো কাউকে বলে না। আমি আগাগোড়া ওর সাথে ছিলাম তাই জানি। তখনই ও আমার সামনে প্রতিজ্ঞা করে যে নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে, বাবার সেই সুখ সেই বিলাসিতা না ফিরিয়ে ও নিজের জন্য ভাববেনা। আমাকে এটাও বলে ও যদি কখনো নিজের প্রতিজ্ঞা থেকে বিচ্যুতও হয় আমি যেন মনে করিয়ে দেই।" শোভা চুপ করলো। তমালও চুপ। কাছের কোনও ঝোপ থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছিল।নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে তমাল উঠে দাঁড়াল,"আমার ভুল আমাকেই রেক্টিফাই করতে হবে। চলুন আপনাকে অটো ধরে দেই।"
































Sunday, 21 October 2018

প্রেম~৭ম

আজ ষষ্ঠ দিন মাটি নিয়মিত যায় তমাল কে দেখতে যায় যার ফলশ্রুতি কলেজ অনিয়মিত। আজ যখন সাইকলজি ক্লাসে ঢুকলো শোভা আগে থেকেই ছিল। মাটি কে দেখে সড়ে গিয়ে বসার জায়গা দিল।
"তমাল কে দেখতে গিয়েছিলি?" শুরুটা শোভাই করলো।
"হুমমম" সংক্ষিপ্ত উত্তর।
"আপসেট মনে হচ্ছে" শোভা বল্ল
"ঠিক আপসেট না। আজ ছেড়ে দেবে, বাড়ি যাবে" মনে হল যেন মাটি দির্ঘ্যশ্বাস টা লোকালো।
শোভা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বল্ল, "তুই বোধহয় ভুলে যাচ্ছিস"
খুব অবাক হয়ে মাটি প্রশ্ন করল, "কি ভুলে গেছি"
শোভা বলে চল্ল, "ক্লাস নাইনে তুই প্রতীজ্ঞা করেছিলি....." ভুলে যাওয়া কথা মনে পড়লো মাটির। বাবার সেবার খুব বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিলো। যেকারনে বাবাকে বড় চাকরিটা ছাড়তে হয়েছিল। একদিন স্কুলে এই শোভার কাছেই মাটি বলেছিলো, আগে আমি নিজের পায়ে দাঁড়বো তারপর অন্যকিছু ভাববো।মাটি এবার সত্যিই আপসেট হয়ে পড়লো। এতো গুরুত্বপূর্ন কথা সে ভুলে গেলো কি করে। বাবার অপমান মার কষ্ট সব ভুলে গেল সে!
ক্লাস শেষ করে বাইরে বেরিয়ে দেখলো প্রবাল একটি ছেলের সাথে কথা বলছে। মাটি গিয়ে সামনে দাঁড়তেই ছেলেটি চলে গেল। প্রবাল মাটির দিকে ঘুরলো।
"খবর পেলেন কিছু৷" মাটির প্রশ্নের উত্তরে প্রবাল বল্ল, "সেটাই তো আশ্চর্য্য লাগছে। কোত্থাও কোনও খবর নেই!"।
" সহেলীর পিছনে লোক লাগান" মাটির কথায় প্রবাল অবাক হয়ে, "আপনি সিওর?!!"
"না সিওর নই তবে আমার ইন্টিউশন তাই বলছে। চার চারটা দিন আমি ওর জন্যই নার্সিংহোমএ অপেক্ষা করেছি কিন্তু ও আসেনি।..... "
"আপনি ঠিক বলেছেন, যেখানে সারা কলেজ জানতো ব্যাপারটা, সেখানে ওকে জানানোর পর ও আকাশ থেকে পরেছিলো" কথা শেষ করে প্রবাল মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেলো।
প্রবাল চলে যেতে শোভা বলে উঠলো, "তুই এই কারনে রোজ যাচ্ছিলি?"
মাটি একটা তির্যক হাসি হেসে বল্ল, "সব যদি তুই বুঝে যেতি তাহলে তো দেশের আর এতো কষ্টই থাকতো নারে!"

আজ তমালের সেলাই কেটে আবার প্লাস্টার করে দেওয়া হবে।আজকের দিনটা থেকে কাল বাড়ি  যাবে। এই কদিন সব সময় মাটি তার সঙ্গে ছিল। যে নিজের পড়াশোনা আর কেরিয়ার নিয়ে এত সচেতন সে সব কিছু দূরে সড়িয়ে শুধু শুধু কেন এখানে এতদিন বসে রইলো? কেন? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করছিল তমাল। দরজায় ক্যাঁচ আওয়াজ, প্রবাল এসেছে। আজ মাটি আসবেনা তমাল জানত। তবে মাটিকে দেখলে, ওর সাথে কথা বললে যে অদ্ভুত ফিলিং হয় সেটা তমালের খুব ভাল লাগে।  বাড়ির লোকের মুখোমুখি ও হবেনা সেটা তমাল জানত। ও সবার থেকে আলাদা। কোনোরকম আডভ্যান্টেজ নেওয়া ওর পছন্দ নয়
"কিরে আজ কেমন ফিল করছিস" প্রবালের কথায় সম্বিত ফিরলো তমালের।
"বেটার, কিছু জানতে পারলি কাজটা কার"
"পরশু পর্যন্ত পারিনি। তবে কাল মাটি একটা ক্লু দিলো। ভেবে দেখলাম ওর কথা দম আছে। সেইমতো ছেলে লাগিয়েছি। একটু দেরী লাগবে হয়তো কারন আমরা দেরী করে ফেলেছি। দেখা যাক। চাপ নিসনা।" প্রবাল যেন নতুন রাস্তা পেয়েছে। কাল যখন এখান থেকে বেরিয়েছিলো খুব মুষড়ে পরেছিলো।
"কি বলেছে মাটি?" তুমালের কথায় হরহর করে বলেদিলো সব কথা প্রবাল।মাটি যে বলতে বারণ করেছিল, সে কথা আর মনেই রইলো না। এত কথার উত্তরে তমাল যখন শুধু "ও" বলল তখন প্রবাল নিজের ভুলটা বুঝলো। তমাল বুঝলো কত বড় বোকা সে! মাটি কোনো মনের তাগিদে নয় এসেছিল থেকেছিলো শুধু স্বার্থের তাগিদে!! মাটির মত মেয়ের কাছে মনের তাগিদ আসা করাই বোকামি। মাটিও অন্য মেয়েদের মতই। ছি ছি ছি কি বোকা সে, বালিতে প্রাসাদ তৈরির স্বপ্ন দেখেছিলো।




















Tuesday, 9 October 2018

প্রেম~ ৬ বর্ণালী রায় পম্পা



মাটি কলেজ ক্যাম্পাসেই এক প্রফেসরএর কাছে টিউশন নেয়।যেদিনই টিউশন থাকে তমাল কোন না কোনো অছিলায় রাত পর্যন্ত কলেজে থাকে। কিন্তু মাটির সামনে আসে না। দেখায় যে সে পার্টির কাজে রয়েছে কিন্তু মাটির বিশ্বাস সে মাটির জন্যই থাকে। মাটির এই ব্যাপারটা একেবারেই ভালো লাগেনা। আজ সে ঠিক করেই এসেছে যে তমালের সাথে এই ব্যাপারে কথা বলবে। স্যারের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে একটু থমকে গেলো, কারন বাইরে ভীষণ অন্ধকার। এটা হয়ে সুবিধেই হল কারন তমাল তাহলে আসেপাশেই আছে। মাটি জোড়ে বলে উঠল, "আড়ালে কেন বেড়িয়ে এস"। একটি পরে গাছের আড়াল থেকে বেড়িয়ে এল ছায়ামূর্তি,  নিসন্দেহে তমাল। মাটি বিরক্ত হয়ে বলে," তুমি আমার পিছু নাও কেন"
তমাল ক'এক সেকেন্ড মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,"তোমার ভুল হচ্ছে, আমি কারোরই  পিছু নেই না, বা নিচ্ছি না"
মাটি এবার বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল," যে ডিউটিটা তুমি এখানে দিচ্ছো সেটা সহেলীর পিছনে দিলে ভালো করবে মনে হয়।"
তমাল কিছুক্ষন মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে চলে গেল ধীরে ধীরে।
মাটি মনে মনে ভাবল 'বাঁচা গেল'।
কিন্তু সত্যিই  কি বাঁচা গেল! পরদিন কোচিং সেরে বেরিয়ে সে অনুভব করল, না আজ আর তমাল নেই তার কাছাকাছি। মন টা একটু বিষন্ন হল।ভেবেছিলো বারন না করলেও হয়তো তমাল শুনবেনা। কিন্তু এইভাবে মেনে নেবে ভাবেনি।
একটু এগিয়ে মোড়ের মাথায় প্রবালকে দেখতে পেল। কয়েকজন ছেলের সাথে উত্তজিত বাক্যালাপ করছিলো। তমাল বড়লোকের ছেলে,  ওর বাবা বড় বিজনেস ম্যান।থাকে 'পশ' এলাকার সুসজ্জিত ফ্ল্যাটে কিন্তু প্রবালের বাবা কলেজের সামান্য কেরানী, থাকে কলেজ ক্যাম্পাসে। তাই ওকে ওখানে ওই সময় দেখে আশ্চর্য হয়নি। কিন্তু মন বলছিলো কিছু একটা খারাপ ঘটনা ঘটেছে। মাটি এগিয়ে গেলো সেইদিকে। মাটি কে এগিয়ে আসতে দেখে ছেলেগুলো কে ছেড়ে এগিয়ে এল প্রবাল। মাটি জিজ্ঞেস করল,"খারাপ কিছু ঘটেছে কি"। প্রবালের মুখ শুকনো, বলল, "খারপ তো বটেই। কাল তমাল তোমার সাথে কথা বলে যখন ফিরে যাচ্ছিলো তখন কেউ বা কারা ওর মাথায় মেরে অচেতন করে বাঁ পা টা ভেঙে দিয়ে গেছে, কম্পাউন্ড ফ্র‍্যাকচার। আজ দুপুরে জ্ঞান ফিরেছে।সবাই খুব চাপে ছিল।এখন অব্জার্ভেশনএ আছে"
"কে করতে পারে বলে মনে হয় আপনাদের" মাটি জিজ্ঞেস করলো
"লোক লাগিয়েছি, দেখি কি খবর আসে। একটু আগে তো শতরূপ ফোন করে খবর নিলো " শতরূপ বিরোধী দলের হেড।
"ফোন করেছিল বলে ও সন্দেহের তালিকার বাইরে নয়" মাটি চিন্তিত গলায় বলল, "আপনার ফোন নাম্বারটা দেবেন?" কথা বলতে বলতে ক্যাম্পাসের গেটের কাছে পৌছে গিয়েছিলো। অটো আসতেই উঠে পড়লো মাটি।
মনটা ভীষণ ভাবে অশান্ত। কিছু ভালো লাগছিলো না। প্রবালকে ফোন করলো মাটি,"আমি কি একবার ওনাকে দেখতে পারি?"
প্রবাল খুব উৎফুল্ল হয়ে বলল," নিশ্চয়ই!  সকালে ১১টা থেকে সাড়ে ১১টা। সকালে কেউ যাবেও না। আপনি নার্সিংহোমএর সামনে চলে আসবেন।আমি বলে রাখব"
মাটি অনুনয়ের সুরে বলল, " দয়া করে ওনাকে জানাবেন না"
ওপার থেকে কোনও উত্তর  না পেয়ে মাটি 'হ্যালো' বলতেই  প্রবালের উত্তর ভেসে এলো, "ওকে বলবনা"

আইসিইউ তে রয়েছে তমাল। মাটি নিশব্দে দরজা খুলে ঢুকলো। তমালের চোখ বন্ধ, সম্ভবত ঘুমাচ্ছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পা বাড়ালো দরজার দিকে। "কিছু না বলেই চলে যাবে!" অভাবনীয় ভাবে তমালের গলা পেয়ে চমকে উঠেছিল মাটি।"তুমি জেগে আছো!!"
"আছি। আমার মন বলছিল তুমি আসবে" তমাল তার স্বাভাবিক ভারি গলাতেই বলল।কিন্তু দূর্বলতা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল।
"কখন কলেজ যাবে?" তমাল জিজ্ঞেস করল। মাটি উত্তর দিচ্ছে না দেখে তমাল বেডের উপরে রাখা মাটির হাতটা ছুঁলো। মাটি শিউরে উঠলো,"তোমার হাত টা কি ঠান্ডা!"
তমাল হাত সড়িয়ে নিয়ে বলল,"এসিতে আছি তো, তাছাড়া প্রচুর ব্লাডও পরে গেছে।" মাটি হাতটা চাদরের ভিতরে ঢুকিয়ে চাদরটা ভালো করে গুঁজে দিলো।
"তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেনা" তমাল পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে যেতে চাইলো।
"কলেজ যাব না" মাটি নখ খুটতে খুটতে বল্ল।
"কেন?"
"এমনি, ভালো লাগছেনা"
"মাটি কলেজ কামাই করছে!অবিশ্বাস্য ঠেকছে।" তমাল মাটির থেকে চোখ সড়ায়নি। মাট অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ  মুখ তুলে বলল, " কেন আমি কি মানুষ নই? আমার কি ইচ্ছা অনিচ্ছা থাকতে নেই"
"তবু তুমি স্বিকার করবে না যে আমি নেই বলে তুমি যাবেনা।" তমাল ঠোঁটের কোনায় হাসিটা ঝুলিয়ে রেখে বলল।
মাটি উঠে দাঁড়ালো, "সময় হয়ে এসেছে"
তমাল করুনস্বরে অনুনয়ের চোখে বলল,"একটু বসো না,কে জানে কবে আবার দেখা হবে তোমার সাথে!"
"তুমি বিশ্রাম করো, আমি আবার আসবো" মাটি বেরিয়ে এল। দরজার লুকিং উইন্ডো দিয়ে দেখলো শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তমাল।

প্রেম~ ৫ বর্নালী রায়


সহেলী কিন্তু নিজেকে বদলাতে পারলোনা অথবা বদলাতে চাইল না। কারন ওর পিছনে সবচেয়ে বড় সাপোর্ট ছিলো তমাল। তবে মাটিও সজাগ হয়ে গিয়েছিল।
ফেয়ারওয়েল হয়ে গেছে, এবার পড়াশোনায় মন দেবার পালা। সেদিন মা বলল,"সবই তো হচ্ছে, শুধু পড়াশোনাটায় মনে হচ্ছে একটু যেন ঢিলা পড়েছে"। মা এমনিতে বকাবকি করে না। এইভাবেই বলে। আজ তাই কলেজে পা দিয়েই মায়ের কথাটা কানে বাজছিলো। আজ আর ক্লাস বাঙ্ক না।
মন দিয়ে ইংলিশ ম্যামের লেকচার শুনছে হঠাৎ মনে হল শোভা কামিজের হাতাটা ধরে টানছে। বিরক্ত হয়ে শোভার দিকে তাকাতেই, দৃষ্টি চলে গেল শোভা কে পেরিয়ে জানলার বাইরে। এই জানলাটা করিডোরের দিকে। সেখানে তমাল দাঁড়িয়ে। মাটির সাথে চোখাচোখি হতেই সড়ে গেল। মাটি শোভার দিকে তাকালো। শোভার মুখে বিষ্ময় পরিষ্কার ফুটে উঠেছে।বিষ্মিত মাটিও, কি দেখছিলো তমাল!

এই ঘটনার পর কেটে গেছে আরও একটা মাস। মাটি ভুলে গেছে সেদিনের সেই ঘটনা। কিন্তু এটা ও বুঝতে পারে যে তমালের বোধহয় কিছু একটা মানষিক পরিবর্তন হচ্ছে যেটা মাটি হয়তো বুঝতে পারছেনা। কারন মাটি কলেজের মধ্যে যেখানেই যাচ্ছে আসেপাশে কোথাও না কোথাও তমাল কে সে দেখছে। হতে পারে সেটা কোইন্সিডেন্ট। মাটি ব্যাপারটাকে পাত্তা দিতে চায়না। কিন্তু শোভা খুচিয়ে খুচিয়ে সেই ব্যাপারটাকেই তুলে আনে বার বার। এই নিয়ে শোভার সাথে একদিন বেশ একচোট হয়েও গেলো।
ইংলিশ প্রজেক্ট করতে হবে শেক্সপিয়ারএর একটা নাটক কে বিশ্লেষণ  করতে হবে। মাটি প্রচুর খেটেছে প্রজেক্টটা নিয়ে। অবশেষে সন্ধ্যেবেলা শেষ করলো লাইব্রেরিতে বসে। কালই জমা নেবে প্রজেক্টটা। শেষ করে চারিদিকে একবার দেখে নিলো। কলেজ ছুটি  হয়ে গেছে অনেকক্ষন। শুধু মাটি আর সহেলী রয়েছে। সহেলীও সম্ভবত প্রজেক্টই করছিল। মাটি পেপারগুলো ভালো করে ফাইল করে টেবিলের ওপরে রেখে বুক গুলো জায়গামত রাখতে গেলো। এসে দেখে ফাইল নেই সাথে সহেলীও নেই।মাটি উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়ে বেড়িয়ে আসে লাইব্রেরি থেকে।দরজার সামনে তমালের সাথে মুখোমুখি ধাক্কা। মাটি মেঝেতে বসে পরে কাঁদতে থাকে।তমাল ভীষনভাবে বিষ্মিত, "তুমি এখনো বাড়ি যাওনি! একি কি হয়েছে!" মাটি যেন তমাল কে দেখে বল পেল। খুলে বল্ল  সব তমাল কে। তমাল শান্ত করল ওকে, " শোন শান্ত হও। তুমি এখন বাড়ি যাও। ব্যাপারটা আমাকে দেখতে দাও। আমি প্রবালকে ডেকে দিচ্ছি। ও তোমাকে বাসস্ট্যান্ড পর্য্যন্ত এগিয়ে দেবে"। মাটি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,"কে প্রবাল!"। তমাল মুচকি হেসে মাটির চোখের জল মুছিয়ে বলে,"ওই যে, আমার ছানা!" মাটির লজ্জায় মুখ লাল হয়ে গেল। সে তাড়াতাড়ি ব্যাগ তুলে হাঁটা দিলো। তমাল পিছন থেকে বলল,"দাঁড়াও!!"। মাটি পিছনে না তাকিয়েই বল্ল, "আমার কাউকে লাগেনা"

সারারাত টেনশনে ঠিকমত ঘুম হলনা। সকালে নির্দিষ্ট সময়ে কলেজ পৌঁছে গেল।গেটেই দেখা হল শোভার সাথে। ওকে সব খুলে বলতে, ও রাগে ফুঁসতে থাকে। বিল্ডিংএর কোলাপ্সিবল পেরতেই সামনে তমাল দাঁড়িয়ে সামনে। এগিয়ে দিলো মাটির প্রজেক্ট কিন্তু ফাইল কভারটা অন্য। মাটি ওটা হাতে নিতেই তমাল মাটির খালি ফাইল কভারটা এগিয়ে দিল যেটা সামান্য আগুনে পোড়া।তমাল মাথা নিচু করে বল্ল,"আমি আগুন থেকে প্রজেক্টটা বাঁচাতে পেরেছি, কিন্তু ফাইলটা..."  কারোরই আর বুঝতে বাকী থাকেনা কে করতে পারে এই কাজ। শোভা প্রচন্ড রেগে প্রায় চিৎকার করে ওঠে, " কোনো শাস্তি আপনি দিচ্ছেন না কেনো ওকে, সব জেনেশুনেও"
তমাল শোভার কথায় উত্তেজিত হয়ে বলে,"শাস্তি তো আমি দিয়েছিলাম। আপনার বন্ধুরই তা পছন্দ হয়নি। আপনার বন্ধুর প্রটেকশনএর জন্য সহেলীকে আমার বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।"
মাটিও এবার উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো,"কে বলেছিল প্রটেকশন দিতে, আমি তোমার পায়ে ধরেছিলাম!!"
তমাল বিরক্ত হয়ে বল্ল, "তোমাকে বলাই বৃথা। কিছু বোঝ না, খালি তর্ক করো" কথা শেষ করে তমাল পিছন ফিরে চলে গেল।
শোভা আর মাটি এসে ক্লাসে বসলো। দুজনেই চুপ, দু'জনেই ভাবছে। হঠাৎ শোভা বলল, "তোরা কবে থেকে তোরা একে অন্যকে 'তুমি' করে বলতে শুরু করলি?"
মাটি বিরক্ত হয়ে বলল, "জানিনা। তোর আর কাজ নেই?"
ধমক দিয়ে শোভার মুখ বন্ধ করে দিলেও প্রশ্নটা মাটির মনেও ঘুরঘুর করতে লাগলো, কবে থেকে আর কেন!!


প্রেম ~৪ বর্ণালী রায় পম্পা



ট্যাক্সিতে যেতে যেতে মাটি ভাবছিলো প্রতিটা ঘটনা। তাহলে কি তমাল সহেলীর ব্রেক আপ হয়ে গেলো! মন থেকে মেনে নেওয়া যাচ্ছিলো না, নিজেকে অপরাধি মনে হচ্ছিলো। তবে এটাও ঠিক সহেলী আজ যেটা করেছে তার কোনও ক্ষমা হয়না। কিন্তু তাই বলে ব্রেক আপটাও মানা যায়না।তবে কি কথা বলবে তমালের সাথে? কিন্তু সেটাও কি ঠিক হবে? একটা সম্পুর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আলোচনা তমাল পছন্দ নাও করতে পারে....

হয়তো বিধাতা চাইছিলেন মাটি কথা বলুক তমালের সাথে। লাইব্রেরিতে মাটির মুখোমুখিই এসে বসলো তমাল। মাটি কিছুক্ষন অপেক্ষা করে একবার "কিপ সাইলেন্ট" বোর্ডটার দিকে তাকালো তারপর ব্যাগ থেকে একটা স্লিপ বার করে লিখলো "একটু কথা ছিলো"। স্লিপ্ টা এগিয়ে দিল তমালের দিকে।একটু পরে মাটির সামনে ও একটা স্লিপ পরলো যাতে লেখা," জানতাম, বাইরে আসুন" তমাল উঠে বেরিয়ে গেছে। মাটিও তমালের পিছু নিলো। লাইব্রেরীর বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল তমাল। মাটিকে দেখেই সামান্য হেসে বলল, "আমি জানতাম আপনি কিছু অন্ততঃ বলবেন।" এরমধ্যেই লাইব্রেরী থেকে দুজন বেরিয়ে গেল এবং ওদের দেখে অর্থপূর্ণ হাসি হাসলো। তমালের চোখ এড়ালোনা,"এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলার থেকে চলুন ক্যান্টিনে বসা যাক"। ক্যান্টিন ফাঁকাই ছিলো। সব ক্লাস চলছে। মাটির প্রথম ক্লাসটা ছিলো না। তবু এসেছিল, প্রথমত তমালের সাথে কথা বলার দরকার ছিল আর দ্বিতীয়ত লাইব্রেরীতে কাজ ছিলো। "বলুন কি বলবেন" তমালের কথায় সম্বিত ফিরল।কোনোরকম ভণিতা নাকরে সরাসরি বলল মাটি"কালকের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রেক আপ একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো না?" মনে হলো তমাল এই কথাটা আশা করেনি। আবার আগের খোলসের মধ্যে ঢুকে গেলো তমাল। গম্ভির হয়ে প্রশ্ন করলো, "আপনার কি মনে হচ্ছে লঘু পাপে গুরু দন্ড হয়ে যাচ্ছে?"
"অবশ্যই, আর তাছাড়া আপনি কি ওকে একটুও ভালবাসেন না!"
মাটির প্রশ্নের উত্তরে তমালের চোখ জ্বলে উঠল, "তমালের কাছে কেউ ভালোবাসা পেতে আসেনা। সবাই সুবিধা পেতেই আসে। তবে আপনি যখন বলছেন আমি সহেলীর সাথে ঝামেলা মিটিয়ে নেব। আশা করি আপনার অপরাধ বোধ আর থাকবেনা..." তমাল শব্দ করে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে বেড়িয়ে গেলো।

পরেরদিন থেকে সহেলীকে সবার দেখা যেতে লাগলো তমালের সাথে। তবে তমাল যেন একটু বেশিই কেয়ার নিচ্ছে সহেলীর। সে হোক, আপত্তি নেই। মাটির প্রতি আর সহেলীর কোনও আক্ষেপ থাকবেনা, এই যা বাঁচোয়া।

Saturday, 6 October 2018

প্রেম ৩

ট্যাক্সিতে যেতে যেতে মাটি ভাবছিলো প্রতিটা ঘটনা। তাহলে কি তমাল সহেলীর ব্রেক আপ হয়ে গেলো! মন থেকে মেনে নেওয়া যাচ্ছিলো না, নিজেকে অপরাধি মনে হচ্ছিলো। তবে এটাও ঠিক সহেলী আজ যেটা করেছে তার কোনও ক্ষমা হয়না। কিন্তু তাই বলে ব্রেক আপটাও মানা যায়না।তবে কি কথা বলবে তমালের সাথে? কিন্তু সেটাও কি ঠিক হবে? একটা সম্পুর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আলোচনা তমাল পছন্দ নাও করতে পারে....

হয়তো বিধাতা চাইছিলেন মাটি কথা বলুক তমালের সাথে। লাইব্রেরিতে মাটির মুখোমুখিই এসে বসলো তমাল। মাটি কিছুক্ষন অপেক্ষা করে একবার "কিপ সাইলেন্ট" বোর্ডটার দিকে তাকালো তারপর ব্যাগ থেকে একটা স্লিপ বার করে লিখলো "একটু কথা ছিলো"। স্লিপ্ টা এগিয়ে দিল তমালের দিকে।একটু পরে মাটির সামনে ও একটা স্লিপ পরলো যাতে লেখা," জানতাম, বাইরে আসুন" তমাল উঠে বেরিয়ে গেছে। মাটিও তমালের পিছু নিলো। লাইব্রেরীর বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল তমাল। মাটিকে দেখেই সামান্য হেসে বলল, "আমি জানতাম আপনি কিছু অন্ততঃ বলবেন।" এরমধ্যেই লাইব্রেরী থেকে দুজন বেরিয়ে গেল এবং ওদের দেখে অর্থপূর্ণ হাসি হাসলো। তমালের চোখ এড়ালোনা,"এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলার থেকে চলুন ক্যান্টিনে বসা যাক"। ক্যান্টিন ফাঁকাই ছিলো। সব ক্লাস চলছে। মাটির প্রথম ক্লাসটা ছিলো না। তবু এসেছিল, প্রথমত তমালের সাথে কথা বলার দরকার ছিল আর দ্বিতীয়ত লাইব্রেরীতে কাজ ছিলো। "বলুন কি বলবেন" তমালের কথায় সম্বিত ফিরল।কোনোরকম ভণিতা নাকরে সরাসরি বলল মাটি"কালকের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রেক আপ একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো না?" মনে হলো তমাল এই কথাটা আশা করেনি। আবার আগের খোলসের মধ্যে ঢুকে গেলো তমাল। গম্ভির হয়ে প্রশ্ন করলো, "আপনার কি মনে হচ্ছে লঘু পাপে গুরু দন্ড হয়ে যাচ্ছে?"
"অবশ্যই, আর তাছাড়া আপনি কি ওকে একটুও ভালবাসেন না!"
মাটির প্রশ্নের উত্তরে তমালের চোখ জ্বলে উঠল, "তমালের কাছে কেউ ভালোবাসা পেতে আসেনা। সবাই সুবিধা পেতেই আসে। তবে আপনি যখন বলছেন আমি সহেলীর সাথে ঝামেলা মিটিয়ে নেব। আশা করি আপনার অপরাধ বোধ আর থাকবেনা..." তমাল শব্দ করে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে বেড়িয়ে গেলো।

পরেরদিন থেকে সহেলীকে সবার দেখা যেতে লাগলো তমালের সাথে। তবে তমাল যেন একটু বেশিই কেয়ার নিচ্ছে সহেলীর। সে হোক, আপত্তি নেই। মাটির প্রতি আর সহেলীর কোনও আক্ষেপ থাকবেনা, এই যা বাঁচোয়া।














প্রেম ২

পড়াশোনার চাপে মাটির খেয়াল থাকেনা কোনো দিকে নজর দেবার। কিন্তু মাঝে মাঝে চোখ চলে যায় তমালের দিকে।এক ইয়ার উঁচু তমালের সমস্ত কাজে মনোনিবেশ দেখে মাটি খুব আশ্চর্য হয়।এর মধ্যে একমাস হতে চলেছে।   ফেসার্স ওয়েলকামএর দিন এসে গেল। নির্দিষ্ট দিনে মায়ের একটা নীল রঙের সিল্ক পড়লো মাটি। শোভার মা শাড়ি পড়েন না বলে মা শোভাকেও একটা শাড়ি বার করে দিলেন। বাবা দুজনকেই ট্যাক্সি করে কলেজে নামিয়ে দিয়ে অফিস চলে গেলো। কলেজের গেট দিয়ে ঢুকতেই মনটা ভিষণ ভালো হয়ে গেল। কি সুন্দর করে সাজিয়েছে চারিদিক। সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই একজন দিদি হাতে একটা গোলাপ ফুল দিয়ে বলল, নাইস ব্যাংগেল। মাটি একটা সৌজন্যমুলক হাসি হেসে করিডোরের দিকে পা বাড়ালো।মা জোড় করে এই চুড়িটা পড়িয়ে দিলো, ঘুঙুর দেওয়া চুড়ি, সবাই তাকিয়ে দেখছে। ধুত বলে মাটি চুড়িটা খুলে ফেল্লো। শোভা আঁতকে উঠলো, খুলিস না!!  কি সুন্দর। শোভাও পরাবে র মাটিও পরবেনা। এই টানাপোড়েনে চুড়ি হাত থেকে মেঝেতে পরে আরও দ্বিগুন আওয়াজ করে গড়াতে গড়াতে চল্ল। কথায় বলে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয় আর বাঘ  করিডরের শেষে দাঁড়িয়ে, চুড়ি বাঘের হাতে। ঠিক এই সময় পিছন থেকে শোভাকে কেউ ডাকলো, শোভা সেদিকে এগিয়ে গেল। তমাল চুড়ি হাতে এগিয়ে এল। মাটির হাতে চুড়ি দিয়ে বল্ল, চুড়ির সৌন্দর্য হাতে, হ্যান্ডব্যাগে নয়। তমাল চলে গেছে। শোভা ফিরে এল। মাটি চুড়ি হাতে গলিয়ে অডিটোরিয়াম এর দিকে এগিয়ে গেল। অডিটোরিয়ামে ঢুকে ওরা একটু অবাকই হল। কারন ওরা ছাড়া কেউ শাড়ি পরেনি। যাইহোক প্রথমে গান হলো, তারপর হলো আবৃত্তি।  মাটিকে অবাক করে আবৃত্তি করলো তমাল।আবৃত্তি শেষে শোভা হাততালি দিতে দিতে বল্ল, ছেলেটা গুন আছে ফালতু ছেলে নয়, বল? মাটি বিরক্ত হয়ে বল্ল আবৃত্তি করলেই কেউ গুনবান হয়ে যায়না। এরপর হলো  শাপমোচন নৃত্যনাট্য।  অসাধারন করল সেকেন্ড ইয়ারের দিদিরা। থার্ড ইয়ারের দিদিরা সবার হাতে খাবার প্যাকেট  দিয়ে গেল।  সবাই  মিলে হইহই করে বেরিয়ে এল। নানা কথা বলতে বলতে কোলাপ্সিবল গেটের দিকে এগোচ্ছিল সবাই। মাটির চোখ গেলো ওয়েস্টপেপার বাস্কেটের দিকে। সেখানে একটা হলুদ কাগজ। এটা সেই কাগজ যেটার মধ্যে তমাল কবিতাটা লিখে রেখেছিল। সকলের দৃষ্টির অগোচরে ও কাগজটা তুলে ব্যাগে রেখেদিল।

পরেরদিন শোভা কলেজ যায়নি। মাটির একটা বই থেকে কিছু নোট নেবার ছিল। এই সুযোগে সেটা হয়ে যাবে। লাইব্রেরীতে ঢুকে দরকারি বই টা নিয়ে লিখতে সুরু করল। কয়েকটা টেবিল পরে তমাল বসেছিল। সেও কিছু নোট নিচ্ছিলো। একটু পরে লাইব্রেরি ম্যাম'এর কাছে গিয়ে কি বলাতে ম্যাম মাটি ক দেখিয়ে দিলেন। তমাল আবার নিজের জায়গায় বসলো। মাটি বুঝলো এই বইটাই ওরও লাগবে। মাটির লেখা হয়ে গিয়েছিল। বইটা তমালের সামনে রেখে সে বেরিয়ে গেল। তমাল দেখলো বই'এর ফাঁক দিয়ে হলুদ রঙের কাগজ উঁকি মারছে। খুলে দেখে তারই কবিতা লেখা কাগজট, তার সাথে আরও একটি ছোট্ট চিরকুট,  তাতে লেখা কবিতার স্থান কবির কল্পনায়, কবির হাতে। চিরকুট টা দেখে তমাল নিজের অজান্তেই হাসলো।

প্রেম ১

মাটির আজ নতুন কলেজ। নামকরা কলেজে তার ভর্তি হয়ে গেল স্রেফ মেরিটের জোড়ে। কলেজে ঢুকেই দেখলো প্রচুর ছেলেমেয়ে। মাটি কে দেখেই শোভা এগিয়ে এলো। শোভা অভিযোগ করলো, স্কুলে কত আগে চলে আসতি আজ এত দেরি কেন করলি, আমি কখন থেকে দাঁড়িয়ে। মাটি বাবা কে চলে যেতে বলল কিন্তু জানে বাবা ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে।

মাটি মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে। ছোটবেলা থেকে সনাতনি প্রথায় মানুষ। মা খুব সনাতনী প্রথায় বিশ্বাসী। সালোয়ার কামিজ, শাড়ি এইসব পরে সে বড় হয়েছে। ক্লাস টেনের পর যখন জিন্স পরার জন্য বায়না করেছিল। তখন মা একটা সর্তেই রাজী হয়েছিলো যে সাথে কুর্তি পরতে হবে টি-সার্ট চলবেনা।এখন কলেজে নতুন সংযোজন, হাফহাতা কাপড়ের জ্যাকেট। বাবা অবশ্য এর কোনও প্রতিবাদ করেনি। তাই মাটিও করেনি।

মাটি আর শোভা খানিকটা এগোতেই পুরনো স্কুলের একজনের সাথে দেখা হলো। কথা বলতে বলতে মাটি খেয়াল করলো একটি ছেলে সবাই কে লাইন করে এক এক করে ভিতরে ঢোকাচ্ছিলো। ঢোকবার আগে মাটি একবার গেটের দিকে তাকালো। বাবা তাকিয়ে আছে। মাটি বাবার দিকে হাত নাড়লো। যে ছেলেটি সবাই কে লাইন করে  ঢোকাচ্ছিলো সে জিজ্ঞেস করলো, বাবা?। মাটি একটু বিরক্ত হয়েই বলল, হ্যাঁ।  তার ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রশ্ন করা মাটি একেবারেই পছন্দ করে না।

সবাই মিলে অডিটোরিয়ামে এসে জড়ো হবার পর একটি সুদর্শন ছেলে সামনে এসে দাঁড়ালো। শোভা মাটির চুড়িদারের হাতাটা টেনে ফিস ফিস করে বল্ল,  জি.এস। ছেলেটি হাতজোড় করে নমস্কারের ভঙ্গি করে বল্ল, "আমি তমাল, এই কলেজের জেনারেল সেক্রেটারি, আপনাদের যেকোনও অসুবিধায় আমি আপনাদের পাশে থাকব। আপনাদের সিকিউরিটির জন্য আমার জানা দরকার আপনাদের সাথে কে বা কারা আসছেন। সেটা বাবাই হোক বা বয়ফ্রেন্ড।" শেষের বাক্যটা মাটির দিকে তাকিয়েই বল্ল ছেলেটি।

অডিটোরিয়াম থেকে বেড়িয়ে শোভা র মাটি কথা বলতে বলতে এগোচ্ছিলো।বা করিডোরে রাস্তা আটকে দাঁড়ালো তিনটি ছেলে। তার মধ্যে যে একটু হোমরা-চোমরা সে বলে উঠলো, কি সুন্দরী  নতুন মনে হচ্ছে। আলাপটা একটু হয়ে যাক। আমি..... কথা শেষ হবার আগেই  মাটি পিছন থেকে শুনতে পেল গলা পরিস্কার করার আওয়াজ। ছেলেটির নজর তখন মাটি কে টপকে পিছন দিকে। শোভা পিছন ফিরে একবার দেখার চেষ্টা করলো কিন্তু মাটি হাত ধরে টেনে ওদের পাশ কাটিয়ে চলে এলো। শোভা এগোতে এগোতে বল্ল, "তমাল ছিলো"। মাটি বল্ল, " সবাই সমান, মেয়েদের ইম্প্রেস করার নিত্য নতুন কায়দা"
মাটির কলেজে ক্যান্টিন আছে এবং যথেষ্ট উন্নত মানের খাবার সেখানে পাওয়া যায় অত্যন্ত স্বল্প দামে। কিন্তু মাটি রোজ বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে যাবারই পক্ষপাতী। অবশ্য এ ছাড়া উপায়ও নেই। টিফিন না দিয়ে মা ছাড়বেই না। পঞ্চমদিনের কথা, সেদিন শোভা ফ্রাইডরাইস আর আলুরদম এনেছিলো। টিফিনে দুজনে তাইই ভাগ করে খেয়েছিল। মাটির টিফিন একদম ধরাই ছিলো। বাড়িতে ভর্তি টিফিন বক্স নিয়ে গেলে মা দেবে আচ্ছা করে তাই টিফিনের পরের পিরিয়ড টা মাটির অফ থাকাতে সুবিধা হলো। শোভাকে ক্লাস পর্য্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আবার ক্যান্টিন ফিরে এল মাটি। টিফিন বক্সটা খুলে খেতে যাবে ঠিক সেই মুহুর্তে তমাল তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ঢুকলো। ক্যান্টিনের বৌদি সব ঝারপোঁছ করছিলেন। তমাল জিজ্ঞেস করলো, "বৌদি কি আছে?" খুব কাচুমাচু হয়ে বৌদি বললেন"সব তো শেষ"। ঘরের মধ্যে যেন বাজ পড়লো। মাটি দেখলো তমালের মুখ ক্ষিদেতে শুকিয়ে গেছে। মাটি ওর টিফিন বক্সটা নিয়ে তমালের টেবিলের কাছে এগিয়ে গেলো। তমাল মুখ তুলে তাকাতে মাটি বলল, "আপনি আমার টিফিন টা খান"। খুব অবাক হয়ে তাকাল তমাল, " আপনি কি খাবেন!"। "আমার পেট ভর্তি আছে। একটু আগেই বন্ধুর টিফিন সেয়ার করেছি। তাছারা আমার মা বলেন অভুক্তকে খাবার দিলে পুন্য হয়"। তমাল মিস্টি হেসে বল্ল, আপনার মা ঠিকই বলেছেন। আজকের এই খাবার আপনার আমার কাছে উধার রইল"। মাটি ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে এলো। কলেজ ছুটির পর মাটি শোভার জন্য অপেক্ষা করছিলো সেই সময় তমালের রাইট হ্যান্ড সমর এসে মাটির টিফিন বক্স হাতে দিয়ে বলল,তমাল বলেছে আপনি কেন ক্যান্টিনের খাবার খান না আজ জানা গেল। মাসিমার হাতের রান্না অসাধারণ।

Friday, 28 September 2018

পুরস্কার

সৌরভ  একজন সুদর্শন ও উচ্চশিক্ষিত যুবক। কিন্তু  চাকরির পরীক্ষায় সে কখনই উত্তীর্ণ হতে পারেনি। যতবারই পরীক্ষা দিতে বসেছে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে, পারবো কি পারবো না,  এই শঙ্কায় জানা জিনিসও সব ভুল করে এসেছে। তাই তার ভালো চাকরি করা আর হলো না। অবশেষে বাবার পরিচিত এক জুতোর দোকানের মালিকের কাছে জুতো বিক্রি করতে ঢুকে গেলো। তার কলেজের সহপাঠী এবং সহপাঠিনীরা জুতো কিনতে আসে তাকে দিয়ে জুতো পায় গলিয়ে চেষ্টা করে আর মুখ টিপে হাসে। সৌরভ  ভয়ে কারো মুখের দিকে তাকাতে পারে পাছে তাকে নিয়ে মশকরা করা সে নিজের চোখে দেখে ফেলে। রোজ সে আসে ঘাড় গোঁজ করে কাজ করে।

এরমধ্যে একদিন মদনদা চেঁচিয়ে বল্ল, "এই সৌরভ 'লেডি ডায়না' টা পাঁচ নম্বরটা  দিদিভাই কে দেখা তো" রোজকার মতো আজও সৌরভ মাথা নীচু করে জুতো পায়ে মাপমত আছে কিনা দেখে সঠিক মাপের জুতো  কাউন্টারএ পাঠিয়ে দিল। মেয়েটি অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিলো ফোনে। তাকিয়ে একবার দেখলোও না জুতোটা কেমন লাগছে। কিন্তু সৌরভ মেয়েটির পা দুটি দেখেছে। এমন সুন্দর পা বোধহয় সিন্ডারেলাই ছিলো। সাহস করে সে আর পা এর মালকিনের মুখের দিকে তাকাতে পারেনি।কারন সে তার যোগ্যতা নিয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিল।

মেয়েটি দোকান থেকে বেরিয়ে যাবার পর হঠাৎই সৌরভ আবিষ্কার করলো যে মেয়েটি তার ছোট্ট পার্সটা ফেলে গেছে। সে পার্সটা খুলে দেখলো ভিতরে একটা কম্প্যাক্ট পাউডার আর একটা মনে হয় হিরের হাতের গহনা রয়েছে। সৌরভ কী করবে ভেবেই পেলনা। দোকানের মালিকটা ভিষন চামার ব্যাগ ওর কাছে জমা দিলে কিচ্ছু থাকবেনা। যদি মেয়েটি ফিরে আসে! সে ব্যাগটা নিয়ে নিজের ঝোলাতে রেখে দিলো।

এরপর বহুদিন হয়েগেছে। দিন ছেড়ে সপ্তাহ,  সপ্তাহ ছেড়ে মাস,  মাস ছেড়ে বছর হতে চল্ল।মেয়েটি আর আসেনি কিন্তু সৌরভ ওই ব্যাগ কাছ ছাড়া করে নি। পুজো এসে গেছে দোকানে প্রচুর ভীড়। হঠাৎই একটা পরিচিত কন্ঠস্বর শুনতে পেলো সৌরভ। চারিদিকে দেখার চেষ্টা করতে লাগলো। তার কোনো ভুল হয়নি এ সেই মেয়েটিরই গলা। কিন্তু কি করে চিনবে সে! মুখ তো দেখেনি। একটু পরেই হাঁক এলো, "সৌরভ  দিদিভাই কে ব্যালেরিনা পাঁচ নম্বরট দেখা তো।" সৌরভ  জুতোটা পায়ে ঢুকাতে গিয়ে দেখলো, হ্যা এই পা সে চেনে দশ মাস আগে এই পায়েই জুতো পরিয়ে ছিলো সে। সে চট করে মুখের দিকে তাকালো। খুব সুন্দরী একজন কমবয়সি মহিলা। মহিলা কে অবাক করে সৌরভ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো, "ম্যাডাম আপনি দু মিনিট  বসুন আমি এক্ষুনি আসছি" কথা শেষ হতে না হতেই সে এক ছুটে ভিতরে গিয়ে ঝোলা থেকে পার্সটা বার করে মহিলার সামনে এসে দাঁড়াল, এগিয়ে দিলো মহিলার দিকে। মহিলা উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছেন ব্যাগ দেখে। ব্যাগ খুলে উনি দ্রুত দেখে নিলেন ওনার মহামুল্যবান গহনাটি। "তুমি এটা কোথায় পেলে!!" উনি বিস্ময়ে হতবাক
"আপনি গতবার এখানেই ফেলে গিয়েছিলেন।" সৌরভ কুন্ঠিত হয়ে বল্ল।সারা দোকানে তখন পিন পরলেও শোনা যাবে। এর মধ্যে মহিলার স্বামীও ঢুকেছেন দোকানে। মহিলা বললেন, "তুমি জানতে এর মধ্যে কি আছে"
"হ্যা ম্যাম"
মহিলা এবং ভদ্রলোক দুজনেই অবাক।
"তাহলে এটা এতদিন এইভাবে রেখে দিয়েছো কেন, বিক্রি কেন করনি"
সৌরভ দীপ্ত কন্ঠে বলে, "মা বলেন গহনা নারীর সন্মান তাকে বিক্রি করা যায়না" ওনারা স্বামী স্ত্রী  মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। এইসম্য মালিক কাউন্টার ছেড়ে উঠে এলো। হাত কচলাতে কচলাতে বল্ল, "ও খুব শিক্ষিত কিন্তু চাকরি পায়নি। খুব গরীব ওরা"
 ভদ্রলোক পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করতে করতে বললেন," সততার যে কোনও  সারর্টিফিকেট হয়না, তাই ও চাকরি পায়নি" উনি একটা ভিসিটিং কার্ড এগিয়ে দিয়ে সৌরভ কে বল্লেন, "কাল অফিসে এসো"








Thursday, 27 September 2018

দিল্লী-আগ্রা একাদশ পর্ব


দিল্লীর শাষনব্যবস্থার টলোমলোতার সুযোগে মারাঠারা 1752 সালে দিল্লীর ক্ষমতা কবজা করে সাথে সাথে ফতেহ্পুর সিক্রী ওদের দখলে চলে আসে। 1803 সালে দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে দিললী আসতেই ফতেহপুর সিক্রীও ইংরেজদের অধিন হয়ে যায় আল তারাযথেচ্ছভাবে রাজমহল ও অন্যান্য বাসভবনগুলিকে ব্যবহার করে এবং ব্যারাক বানিয়ে নষ্ট করে ফেলে। কিন্তু লর্ড কার্জন যখন ক্ষমতা হাতে পান, নষ্ট হওয়া ইতিহাস পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন। এখন যে টুকু আমরা দেখতে পাই তা লর্ড কার্জনেরই জন্য।
আর একটি স্থাপত্যের ইতিহাস জেনে আমার খুব খারাপ লেগেছিল। সেটি হল সম্রাট আকবরের সমাধি। আমি আগের বার গিয়েছিলাম, এবার যাবার সময় হয়নি। আকবরের সমাধি দেখে মনে হয়েছিল এতবড় একজন সম্রাটের সমাধি এত সাধারন সাজসজ্জা কি করে হয়!!.......আকবরের সমাধি তৈরী হতে সময় লেগেছিল 1605 - 1613 সাল। আকবর তার জীবদ্দশায় স্থান ঠিক করে গিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর জাহাঙ্গীর তৈরী করেন। তিনি দামি পাথর হিরে জহরত দিয়ে অপূর্ব করে এর সাজসজ্জা করেন। মাটিতে পাতেন দামী পার্শিয়ান কার্পেট। এক কথায় অসাধারন ছিল সে সমাধি মন্দির।
আকবরের প্রপৌত্র ঔরঙ্গজেবের সময় জাঠদের উত্থান হয় রাজা রাম জাঠের নেতৃত্বে।পরবর্তিকালে জাঠরা আগ্রা ফোর্ট জয় করে নেয় মোগলদের হারিয়ে। সেই সময় তারা আকবরের সমাধি থেকে সোনা দামী হিরে জহরত সব খুবলে তুলে লুঠ করে। এবং সব থেকে অমানবিক কাজ যা তারা করেছিল তি হল , রাম জাঠের বাবা গোকুলের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে আকবরেল সমাধি থেকে আকবরের কঙ্কাল তুলে পুড়িয়ে দেয়।...... তাই আকবরের যে সমাধি আমরা দেখি সেখানে আকবরের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।
পরের পর্বে দিল্লীর লালকেল্লা সম্বন্ধে জানাবো।

দিল্লী-আগ্রা চতুর্থদিন দশম পর্ব


যদিও মোগোল বংশ এক বিশাল বংশ। তাদের সবাইকে কি আমরা জানি? আমরা শুধু ঔরঙ্গজেব পর্য্যন্ত জেনে এসেছি। আর দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ জাফরকে জানি কারণ তিনি ছিলেন শেষ মোগল সম্রাট। এদের সকলের মধ্যে আমরা মনে রেখেছি শুধু দুজনকে আকবর আর শাহ্জাহান। আকবরের সৃষ্টি ফতেহ্পুর সিক্রী আমরা দেখেছি। আমরা শাহ্জাহানের সৃষ্টি তাজমহলও দেখেছি। অনেকেই জানেন না যে দিল্লী লাল কেল্লা শাহ্জাহানেরই সৃষ্টি। সে যাই হোক প্রথমে আসি আগ্রা ফোর্টের কথায়।
আগ্রা ফোর্ট 380,000 স্কোয়ারমিটার অর্দ্ধ গোলাকৃতি একটি 4গেট যুক্ত ফোর্ট। খিজরি গেটটি যমুনার দিকে খোলে। দূর্গের পশ্চিম দিকে গেট যেটি শহর মুখী সেটি দিল্লী গেট। এটি 1568 সালে তৈরী হয় নিরাপত্তা ও সম্রাটের নিজস্ব প্রবেশ দ্বার হিসেবে।এই গেটটি পরবতী কালে শ্বেত পাথর দিয়ে নতুন করে অলঙ্কৃত হয়। এই গেটের ভিতরের দিকে দুটি প্রমাণ সাইজের পাথরের হাতি রাখা হয়েছিল তাই একে 'হাথিপোল'ও বলা হত। আর একটি গেট ছিল লাহোর গেট যেটি পরবর্তীকালে অমর সিং গেট বলে খ্যাত হয় এবং সেটিই জনগনের প্রবেশ দ্বার। দিল্লীগেট এখন ইন্ডিয়ান আর্মির অধিন।সাধারনের প্রবেশ নিষেধ।
1526-এ প্রথম পানিপথের যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদিকে হারিয়ে বাবর এই দূর্গে বাস করতে শুরু করেন।পানীয় জলের জন্য তিনি একটি বাওলি তৈরী করেন। যার উপস্থিতি এখনও আছে দেওয়ানি আম-এর সামনে।তারপর বিভিন্ন সময় মালিকানা বদল হয়েছে।আকবরের সময় থেকে এটি বংশ পরম্পরায় মোগলদের হয়। আবুল ফজল তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছিলেন যে এই দূর্গ পূর্বে বাদলগড় নামে পরিচিত একটি ইটের তৈরী দূর্গ ছিল। আকবর যখন আগ্রাকে রাজধানী হিসাবে ঘোষণা করেন তখন এটি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। রাজস্থানের বারাউলি থেকে লাল বেলে পাথর নিয়ে এসে নতুন করে এটি তৈরী শুরু হয়। 1573 সালে নতুন দুর্গটি সম্পূর্ণ হয়। আমরা এখন অবস্থায় দেখি তার প্রায় বেশিরভাগ শাহ্জাহানের সময়েই হয়। তিনি নিজের মহল তৈরীর জন্য আকবরের সময়কার বেশকিছু স্থাপত্য ভেঙ্গে ফেলেন। ঔরঙ্গজেব রাজধানি দিল্লীতে স্থানান্তরিত করার ফলে এই দূর্গে আর বাস করেন নি। পরবর্তী মোগল শাসকরা দিল্লী লাল কেল্লাতেই থাকতেন। এরপর এটি মারাঠাদের দখলে চলে যায়। আর তারপর ইংরেজ দের দখলে।
গেট দিয়ে ঢুকেই প্রথমে বেঙ্গলী মহল। যেটি পরে আকবরি মহল ও জাহাঙ্গিরি মহলে বিভক্ত হয়ে যায়।জাহাঙ্গির তাঁর বইতে এই মহলের উল্লেখ করেন। কিন্তু এই ব্যাপারে তিনি তার পিতাকেই প্রসংসিত করেছেন। পরবর্তীকালে নুরজাহান এই প্রাসাদে তার মৃত্যু পর্য্যন্ত বাস করে গিয়েছিলেন। তাই এখন এটি নুর জাহান মহল নামেই পরিচিত।
আকবরের পছন্দের স্থান কিন্তু আগ্রা ছিল না, ছিল ফতেহ্পুর সিক্রী।ফতেহ্ কথাটা শুনেই বোঝা যায় যে এখানে জয়ের কোনও ইতিহাস আছে। ঠিক তাই, চিতোর এবং রনোথম্বর জয়ের পর আকবর 1569-এ একটী নতুন জায়গায় রাজধানি সরিয়ে নিয়ে যেতে চান। সে হল আগ্রা থেকে 37 কি.মি দূরে বর্তমানের ফতেহ্পুর সিক্রী। তখন এর নাম ছিল ফতেহ্ বাদ। এই জায়গা শুধু আকবরের নয় তার পিতামহ বাবরেরও পছন্দের ছিল। এই পরকল্পিত শহরের বাইরে বাবর একটি বাগান তৈরী করেছিলেন রানা সঙ্গকে পরাস্ত করার পর। 1585তে অপর্যাপ্ত জল এবং আরও নানা কারণে আকবর তার রাজধানী লাহোরে স্থানান্তরিত করেন। কিন্তু 1601-এ আবার তিনি ফিরে আসেন এখানে।তাঁর মৃত্যুবধি তিনি এখানেই রাজধানী রেখেছিলেন। এরপর জাহাঙ্গীর এবং শাহ্জাহান আগ্রাতেই রাজধানী বহাল রেখেছিলেন আর ঔরঙ্গজেব দিল্লীতে।ইতিহাসে তখন ফতেহ্পুর সিক্রীর কথা জানা যায়নি। এরপর আবার ফতেহ্পুর সিক্রীর উল্লেখ পাওয়া যায় অন্যতম সৈয়দ ভাইয়ের খুন হওয়া থেকে। প্রশ্ন আসে কে এই সৈয়দ ভাই? সৈয়দ ভাইরা ছিলেন দুই ভাই সৈয়দ হাসান আলি খান ও সৈয়দ হুসেন আলি খান। বলা যেতে পারে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মোগল রাজনিতীর ভাগডোর এই দুই ভাইয়ের হাতেই চলে যায়। এই দুই ভাই ছিল ঔরঙ্গজেবের আইনসভার খুব গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকার। 1710-এ ঔরঙ্গজের মারা যাবার পর প্রথম বাহাদুর শাহ্ তার ভাইদের পরাস্ত করে সিংহাসন অধিকার করে সৈয়দ ভাইদের সাহায্যে।1712-তে বাহাদুর শাহ্ মারা গেলে তার উত্তরাধিকার জাহানদার শাহ্ কে সৈয়দ ভাইদের নির্দেশে হত্যা করে জাহানদারের ভাগ্নে ফারুকশিয়ারকে 1713-তে সিংহাসনে বসায়। ফারুকশিয়ার সৈয়দ ভাইদের তুষ্ট করতে না পারায় তাকে অন্ধ করে হত্যা করে এবং ফারুকশিয়ারের বড় খুরতুতো ভাই রফি উদ দারাজাতকে 1719-এর ফেব্রুয়রিতে সিংহাসনে বসায় দুই ভাই।দারাজাত ঐ বছর জুন মাসে ফুসফুসের রোগে মারা গেলে তার ভাই রফিউদদৌল্লা(দ্বিতীয় শাহ্জাহান )কে বসানো হয়, সেও ঐ একই রোগে সেই বছর সেপ্টেম্বরে মারা যায়।তখন তার 17 বছরের ছেলে মহম্মদ শাহ্কে সৈয়দ ভাইরা সিংহাসনে বসায়। 1720-তে মহম্মদ শাহ্ হুসেন আলিকে ফতেহ্পুর সিক্রীতে খুন করে এবং হাসান আলিকে বিষ প্রয়োগ করে মারা হয়। এখান থেকে আবার ফতেহপুর সিক্রীর উল্লেখ পাওয়া যায়। বাকি আবার পরের পর্বে জানাব।

দিল্লী-আগ্রা চতুর্থদিন 12/10/17 নবম পর্ব


আকবরের প্রথমা স্ত্রী রুকাইয়া বেগম ছিলেন নিঃসন্তান।পরবর্তীকালে জাহাঙ্গীরের পুত্র খুরম অর্থ্যাৎ শাহ্জাহানকে দত্তক নিয়ে নিজের মত করে মানুষ করেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্ত্রীর উল্লেখ অপ্রয়োজনীয়।চতুর্থ স্ত্রী ছিলেন সলিমা সুলতান বেগম। যিনি ছিলেন বৈরাম খানের স্ত্রী।কিন্তু আকবর চিরকাল এঁনাকে নিজের নয় বৈরাম খানের স্ত্রী হিসেবেই সন্মান করে এসেছেন। পঞ্চম স্ত্রী ছিলেন আমের রাজ বিহারিমল বা ভারমলের কন্যা যোধাবাঈ বা হরকা বাঈ। যিনি আকবরের প্রথম পুত্র সন্তান সেলিমের মা ছিলেন। যেহেতু তিনি পুত্র সন্তান উপহার দিয়েছিলেন তাই আকবর তাকে মরিয়ম-উজ-জমানি নামে ভুষিত করেন। এবং এই নামই সর্বত্র উল্লেখ আছে। আবুল ফজল একজায়গায় লিখেছেন যে আকবর ছিলেন তার পূর্বপুরুষের থেকে অনেক বুদ্ধিমান। তিনি বিনা যুদ্ধে কেবলমাত্র বিবাহ করে অর্ধেক রাজপুতনা জয় করে ফেলেছিলেন। পরবর্তিকালে তিনি বিকানির ও জয়সলমীরের রাজকন্যাকেও বিবাহ করেন। আকবরের প্রিয় পুত্র ছিলেন দানিয়েল মির্জা। তার মায়ের নাম জানা যায়নি। আকবরের সাথে তার বড় পুত্র সেলিমের কোনওদিনই সদ্ভাব ছিল না। কিন্তু দানিয়েল আকবরকে দাক্ষিনাত্য জয়ে সর্বত ভাবে সাহায্য করেন। এবং পরবর্তিকালে দাক্ষিনাত্যেল শাষনভার আকবর তার হাতেই দেন। আকবর আরও ন'জন মানুষের ওপর খুব নির্ভর করতেন তাঁরা হলেন লেখক ও ইতিহাসবিদ আবুল ফজল,গায়ক তানসেন, প্রধান সেনাপতি মানসিং,অর্থমন্ত্রী তোডরমল, বিদুষক বীরবল, বৈরাম খান পুত্র বিদ্যান আবদুল রহিম,কবি ফৌজি যিনি আবুল ফজলের দাদা ছিলেন, মোল্লা দো পেয়াজা আর এক বিদুষক ও বীরবলের প্রতিদ্বন্দি এবং পরামর্শদাতা ফকির আজিওদ্দিন- যাঁরা একত্রে 'নবরত্ন' বলে পরিচিত ছিলেন। আকবর 3রা অক্টোবর 1605-এ এক dysentery তে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পরেন ও 27 শে অক্টোবর 1605-এ মারা যান। আকবর শেষ জীবনে মানষিক ভাবে ভেঙ্গে পরেছিলেন। কারন তাঁর কাছের মানুষরা অর্থ্যাৎ তার নবরত্নের রত্নরা একে একে মারা যান এবং সুযোগ বুঝে রাজকুমার সেলিম বিদ্রোহ করে বসেন। জাহাঙ্গীরনামা অনুযায়ি আকবরের বাকি দুই পুত্র মুরাদ মির্জা সুলতান এবং দানিয়েল মির্জা ছিলেন রাজ দাসীর পুত্র তাই তারা সিংহাসনে বসার যোগ্য নয়। মুরাদ সিংহাসন নিয়ে উৎসাহি ছিলেন না। শেষজীবনে তিনি তার বাবার সাথেই কাটিয়ছেন।আকবর দানিয়েলকেই শাসক হিসাবে উপযুক্ত মনে করতেন। তাই দোটানার মধ্যে পরে যুবরাজ সেলিমের 36বছর বয়স হয়ে গেলেও রাজ্যাভিষেক হয়নি। সেলিম তার মায়ের সমর্থন না পেলেও তার দুই সৎমা রুকাইয়া এবং সলিমার সমর্থনে আকবর মারা যাবার 8দিন বাদেই 3রা নভেম্বর সিংহাসনে বসেন।জাহাঙ্গীর এতটাই ক্ষমতালোভী ছিলেন যে নিজের বিদ্রোহি বড় পুত্র খসরুকে অন্ধ করে দিতেও এতটুকু হাত কাপেনি এবং পরে শাহ্জাহান একে হত্যা করেন। জাহাঙ্গীরের মামা আম্বের রাজা ভগবান দাসের মেয়ে মনভাবতী বাঈ-এর সাথে বিবাহ হয়।জাহাঙ্গীর তার নাম দেন শাহ্ বেগম আর তার সন্তান হয় খুসরু মির্জা। যেহেতু মা ছিলেন রাজপুত, হয়তো সেই কারনেই জাহাঙ্গির বেশ কয়েকজন রাজপুত রাজকুমারিকে বিবাহ করেন। তার মধ্যে উল্লখযোগ্য ছিলেন মারওয়া-র বর্তমানে যোধপুর-এর রাজকন্যা উদয় সিং-এর কন্যা 'যোধবাঈ'। যোধাবাঈ নয় কিন্তু! পরবর্তিকালে ইনি পরিচিত হন জগৎ গোসাইনি নামে। ইনিই জনাম দেন পরবর্তী সম্রাট শাহ্ জাহান কে।ইনি জাহাঙ্গীরের প্রিয় রানি ছিলেন যতদিন না নুর জাহান কে জাহিঙ্গীর বিয়ে করেন। 1611তে নুর জাহানেল সাথে বিবাহ হয় আল 1619-এ জগৎ মারা যান। মৃত্যুর পর ইনি বিলকিস মাকানি উপাধি পান। ইনি কিন্তু পাটরানী ছিলেন না। পাটরানি বা সম্রাঙ্গী ছিলেন সালিহা বানু বেগম যিনি জাহাঙ্গীরের প্রথম স্ত্রী ছিলেন। 1605 থেকে 1620-তার মৃত্যু পর্য্যন্ত এই পদটি ইনিই অলংকৃত করেছেন। 1620 তে ইনি মারা যাবার পর নুরজাহান সম্রাঙ্গির পদটি পান।28শে অক্টোবর 1627 সালে 58বছর বয়সে ঠান্ডালেগে কাশ্মীরে জাহাঙ্গীর মারা যায়। জগৎ প্রথমে তিনটী কন্যা সন্তানের জন্ম দেন কিন্তু তিনটিই শিশু অবস্থাতেই মারা যায় তাই যেই মুহূর্তে খুরমের জন্ম হয় 6 দিন বয়সে আকবর রুকাইয়ার কাছে খুরম কে প্রেরণ করেন। রুকাইয়ির কাছেই শাহজাহান মানুষ হন। শাহ্জাহান আর মুমতাজের ঘটনা নতুন করে বলার কিছু নেই। শাহ্জাহান এত আড়ম্বর প্রিয় ছিলেন যে অগাধ অর্থ খরচ করে রাজকোষ প্রায় শূন্য করে ফেলেন।তখন তার পুত্র ঔরঙ্গজেব আগ্রাফোর্টে বন্দী করে ফেলেন কিন্তু শাহ্জাহান আত্মসমর্পন না করায় যমুনার থেকে কেল্লায় জল সরবরাহ পদ্ধতিটি বন্ধ করে দেন। শাহজাহান আত্মসমরপন করতে বাধ্য হন। শেষ পাঁচ বছর এখানেই বন্দী থাকেন তিনি।
পরের পর্বে এঁনাদের সৃষ্টির ঐতিহাসিক কাহিনি জানাবো।

দিল্লী-আগ্রা চতুর্থদিন 12/10/17 অষ্টম পর্ব


আমাদের দিল্লী যাবার বাস আগেই বুক করাছিল। আগ্রার হোটেলের টাকা মিটিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। যথাসময় বাস ছাড়লো।
বাস ছুটে চলেছে দিল্লীর দিকে আর আমি ডুবে গেলাম ইতিহাসে। ইতিহাস চিরকাল আমার প্রিয়। তাই কোথাও যাবার সময় সেখানার বিষয়ে আদ্যপান্ত জেনে তবেই আমি পা রাখি। আজকাল কিছু জানতে হলে, কোনও অসুবিধা নেই নেট দেখো। তবে নেট দুনিয়ায় প্রচুর ভাওতাবাজি আছে। ভুলভাল তত্ত্বে পূর্ন করে একটা ডকুমেনট্রি বা একটা পেজ খুলে ফেললেই হল। জনগন খাবে ভাল! Wikipedia কে নির্ভরযোগ্য বলা যেতে পারে। তবে আমি মোগল ইতিহাস জানতে নির্ভর করেছি, বাবরনামা-যেটি বাবর নিজেই লিখেছিলেন, হুমায়ুননামা-যেটি বাবর কন্যা এবং হুমায়ুনের বোন গুলবদন বেগম লিখেছিলেন, আকবর নামা এবং আইন-ই-আকবরি- দুটিই লিখেছিলেন আকবরের বন্ধু তথা 'নবরত্ন'এর একজন, আর তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরি-যেটি লিখেছিলেন জাহাঙ্গীর নিজেই, এইবইগুলিল ওপরেই নির্ভর করেছি। আসল গুলির হিন্দি অনুবাদগুলোই আমাকে জানতে সাহায্য করেছে।
মনে প্রশ্ন জেগেছিল কিভাবে এই আগ্রাফোর্ট, তাজমহল, দিল্লী লালকেল্লা পেয়েছি। জানতে হলে চলে যেতে হয় সেই 1495 সালে যখন 12 বছরের বাবর বসেছিলেন ফেরজানার মসনদে তার বাবার মৃত্যুর পর। আত্মীয়স্বজনের বিরোধিতায় জেরবার বাবর এর দুবছর বাদে সমরখন্দ জয় করলেন। কিন্তু হাত থেকে ফেরজানা বেরিয়ে যায়।1501-এ ফেরজানা আবার জয় করলেন তো সমরখন্দ হাত থেকে বেরিয়ে গেল।অবশেষে 1504 -এ তিনি দুটিই জয় করেন।এরপর কাবুলও তিনি জয় করেন। কিন্ত এইভাবে বাবর সুখি ছিলেন না। তার স্বপ্ন ছিল একছত্র অধিপতি হবার। তখন তার নজর পড়ে উত্তর ভারতের দিকে। সেখানে তখন ইব্রাহিম লোদি ক্ষমতায়।1526-এ প্রথম পানিপথের যুদ্ধে লোদিকে পরাস্ত করে দিল্লীর মসনদে বসে মোগল সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। যেহেতু আমি ইতিহাস বই লিখতে বসিনি তাই বিশেষ detail-এ যাচ্ছিনা। বাবরের তৃতীয় স্ত্রী মহাম বেগমের সন্তান ছিলেন হুমায়ুন। প্রথম স্ত্রী আয়সা সুলতান বেগমের ছিল একটি কন্যা আর দ্বিতীয় স্ত্রী জৈনব সুলতান বেগম নিঃসন্তান অবস্থায় বিয়ের দুবছরের মধ্যেই মারা যান।বাবর খুব কম বয়সে মাত্র 47 বছর বয়সে 1530সালে মারা যান। কেন এবং কিভাবে তা সকলেরই জানা।
পিতার মৃত্যুর পর 23 বছর বয়সে অনভিঞ্জ হুমায়ুন ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু অনভিঞ্জতার কারনে একে একে সব হাত ছারা হয়ে যায় সৎ ভাই আর শের শাহ্ সুরির কাছে। 15 বছর পর এক এক করে সব আবার তিনি জয় করেন।পিতার মত তিনিও 47 বছর বয়সে 1556 সালে মারা যান। দু হাতে বই নিয়ে তাঁর গ্রন্থাগার থেকে নামছিলেন। সেইসময়ে আজানের ডাক আসে। তাঁর অভ্যাস ছিল যে অবস্থাতেই তিনি থাকুন না কেন হাটু গেড়ে বসে পরতেন। সেই প্রচেস্টা করতে গিয়ে পোশাকে পা জড়িয়ে সিঁড়ি থেকে পড়ে যান এবং তার ঠিক তিন দিন বাদে তাঁর মৃত্যু হয়। হুমায়ুনের প্রথমা স্ত্রী বেগাবেগম ছিলেন হুমায়ুনের মামাতো বোন। তার সন্তান আল-আমন-মির্জা ছিল হুমায়ুনের প্রথম সন্তান কিন্তু সে শিশুকালেই মারা যায়। এরপর দ্বিতীয় স্ত্রী হামিদা বানু বেগমের সন্তান হয় আকবর।
1542 সালে যখন হুমায়ুন তাঁর পরিবার সহ সিন্ধের ওমরকোট দূর্গে হিন্দু রাজা রানা প্রসাদের আশ্রিত ছিলেন, সেই সময় আকবরের জন্ম হয়। হুমায়ুন যখন সাম্রাজ্য হারিয়ে আশ্রিত হয়ে রয়েছেন সেই সময় তার সৎ ভাই কামরান মির্জা আর আসকারি মির্জা আকবরকে কাবুল নিয়ে যান। সেখানে সমস্ত রকম তালিম পান আকবর কিন্তু লেখাপড়া তিনি শেখার সুযোগ পাননি। 1551 সালে হুমায়ুনের প্রিয় ভ্রাতা হিন্দল মির্জা এক যুদ্ধে মারা যান। এতে হুমায়ুন খুব ভেঙ্গে পরেন এবং হিন্দল মির্জার ন'বছরের কন্যা রুকাইয়া বেগমের সাথে ন'বছরের আকবরের বিবাহ দেন।আকবরের কথা বলতে গেলেই খুব স্বাভাবিক ভাবে বৈরাম খানের কথা চলে আসে। বৈরাম খাঁ ছিলেন হুমায়ুনের খুবই বিশ্বস্ত এবং হুমায়ুনের অবর্তমানে আকবরের অভিভাবক হয়ে মোগলদের নুয়ে যাওয়া ধ্বজা তুলে ধরেন।বৈরাম খাঁ 16বছর বয়সে বাবরের সেনাবাহীনিতে যোগ দেন আর নিজের দক্ষতায় ধীরে ধীরে হুমায়ুনের প্রধান সেনাপতিতে উন্নিত হন। হুমায়ুনের অকস্মাৎ মৃত্যুতে দিল্লীর সিংহাসন টলমল হয়ে পরে। ন'মাস বাদে 7ই অক্টোবর 1556 হিন্দুরাজা হিমু দিল্লী আক্রমণ করে বসে।এর ঠিক এক মাস বাদে 5ই নভেম্বর 1556 তে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে বৈরাম খানের সেনা হিমুর একটি চোখ কানা করে পরাস্ত এবং পরে হত্যা করে।নাবালক আকবর কে সিংহাসনে বসিয়ে অভিভাবক হয়ে কাজ করতে থাকেন বৈরাম খান। কিন্তু আকবরের সাথে মতের মিল না হওয়ায় বৈরাম খানকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে বলা হয়। বৈরাম খান যখন স্ত্রী পুত্র নিয়ে মক্কা শরিফ রওনা হন তখন হিমুর সহচর হাজি খান মেওয়াটি হিমুর হত্যার প্রতিশোধ নিতে বৈরাম খান কে হত্যা করেন এবং তাঁর স্ত্রী সলিমা বেগম ও পুত্র রহিমকে আগ্রা পাঠিয়ে দেয়।পরবর্তীকালে সলিমা বেগমকে আকবর নিকাহ্ করেন এবং রহিম রাজসভায় নবরত্নদের মধ্যে একজন হয়।
বাকি অংশ জানাচ্ছি পরের পর্বে.....

দিল্লী-আগ্রা তৃতীয়দিন 11/10/17 সপ্তম পর্ব


গাড়ী ছুটে চলেছে আগ্রার দিকে।মন কিন্তু পড়ে রয়েছে ফতেহপুর সিক্রীতেই।কি আশ্চর্য্য, কি অভাবনীয় যে কত হাজার বছর আগে একজন মানুষ তার জীবনের লড়াইটা এখান থেকে শুরু করে এখানেই শেষ করেছিলেন। আর আমরা এত বছর পরে তার ভগ্নাবশেষ দেখছি। যখন তিনি তৈরী করেছিলেন তখন তিনি ভাবেনও নি যে তার তৈরি এইসব থাকার জায়গা কেউ অবাক বিস্ময়ে দেখবে।
চড়া রোদ্দুরে মাথা ব্যাথাটা আরও বেড়েছিল। মায়ের কাছে একটা ছাতা ছিল কিন্তু সে ছাতাও আমার মাথা ব্যাথার কিছুমাত্র আরাম দিতে পারেনি।রাজা উঠেই বলেছিল ড্রইভারকে একটা খাবার জায়গা দেখে দাঁড়াতে। একটা পাঞ্জাবী ধাবা দেখে গাড়ী দাড়াঁলো। খাবার দাবার খুব ভাল ছিল, মালিকও খুব যত্নবান ছিল। আমি অল্প স্যুপ খেলাম। আবার গিয়ে চড়লাম গাড়ি। আমার শরীরটা চাইছিল ঘুম। জানলায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরলাম।
আগ্রায় ঢুকেছি বোঝা যায় একটা জিনিষেই, অজস্র লালমুখো বাঁদরের উপস্থিতিতে। আগ্রার বিখ্যাত মিঠাই হল 'পেঠা'। এটা আর কিছুই না সিম্পলি 'আনারসের মোরব্বা'। তবে রাজার এক নেশা আছে যেখানে যাবে সেখানকার সব কিছু কিনবে এবং খাবে। তাই পেঠাও তাকে নিতেই হবে। এখানকার পঞ্ছী পেঠা প্রসিদ্ধ। তারই একটা দোকানের সামনে নিয়ে ড্রাইভার দাঁড় করালো। আমরা পেঠা কিনে হোটেলের উদ্দ্শ্যে রওনা দিলাম।
কাল আমরা রওনা দেব দিল্লী কিন্তু আমার মন খারাপ হয়েযাচ্ছিলো। আরও কিছুদিন যদি থাকা যেত ! আরও একটু ভালো করে দেখা যেত! সময়াভাবে এই ঝটিকা সফর, মন ঠিক মানলো না। তবে এইটুকু শান্তনা পেলাম যে, যে সব জায়গা,স্মৃতিসৌধ দেখতে বিদেশীরা ভীড় জমায়, সে সব কিছু নিজের দেশে থাকা সত্ত্বেও দেখিনি, আজ দেখলাম। আজ দেখলাম সেই ইতিহাস মোড়া শহর কে। বিদায় আগ্রা! যুগযুগ ধরে বাঁচিয়ে রেখো তোমার এই ইতিহাসের নায়কদের।

দিল্লী-আগ্রা তৃতীয়দিন 11/10/17 ষষ্ঠ পর্ব


কেল্লা থেকে বেরিয়ে গাইড বিদায় নিল। সে শুধু আমাদের যোধাবাঈ মহল যাবার রাস্তাটা দেখিয়ে দিল। আমরা টিকিট কেটে প্রবেশ করলাম। রোদের সাথে সাথে আমার মাথাব্যাথাও চরছিল। মাথার একটা বিশেষ জায়গায় চাটি মারলে ব্যাথাটা খানিক প্রশমিত হয়। আমি মাঝেমাঝেই সেটা করছিলাম। হঠাৎ দেখি এক বিদেশিনী অবাক চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। বুঝলাম ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। শেষে হয়তো আগ্রা পাগলাগারদেই চালান হয়ে যাব!
আকবর মানেই তো লাল বেলে পাথর, এখানেও তার উপস্থিতি। পাথরে সুন্দরconstruction আর নকশা দুটো দেখলেই বলে দিতে হয় না যে এ নিশ্চিত ভাবে যোধাবাঈ মহল। কারণ এতে রয়েছে রাজস্থানি শিল্পকলার ছোঁয়া। অবশ্য আকবর নিজেও একপ্রকার রাজপুত বলা যেতে পারে। কারণ আকবরের জন্ম হয়েছিল এক রাজপুতের ঘরেই এবং ছোট থেকে বালক হওয়া সেখানেই। তাই রাজস্থানি রহন-সহন তাঁর মজ্জা গত ছিল,রক্ত তার মোগল হলেও। জানলা, কুলুঙ্গি, ঠাকুরের আসন সব কিছুতেই রাজস্থানি শিল্পকলার ছাপ সুস্পষ্ট। একতলা, দোতলায় পুরোমহল সুবিন্যস্ত। মহল টা ছিল ঠিক আগেকার দিনের জমিদার বাড়ীর মত। মাঝখানে বিশাল প্রশস্ত এলাকা আর চারপাশে ঘর। মহল থেকে বেরিয়ে শাহী রান্নাঘর। যদিও সেটি তালাবন্ধ থাকার কারণে আমরা ভিতরে ঢুকে দেখতে পেলাম না। এরপর এক এক করে পঞ্চমহল, অনুপ তালাও, দেওয়ানি আম দেওয়ানি খাস দেখলাম। সব থেকে interesting লেগেছিল কোষাগার। দেওয়াল লাগোয়া ছোট ছোট চৌবাচ্চার মত। উপরটা টেবিলের মত তার মাঝখানে 12ইঞ্চি/12ইঞ্চি গর্ত, যেটা আবার পাথরের স্লাইডিং ঢাকা দেওয়া। মেঝেতেও একটা বড় আয়তকার পাথর আলগা। তাতে একটা গোলাকার ছোট গর্ত। অনুমান করা যায় ঐ গর্তর মধ্যে কিছু ঢুকিয়ে চাড় দিয়ে খোলা হত।
দেওয়ানি খাসের মাঝখানে রয়েছে লোটাস পিলার। সুন্দর পাথরের নকসা তাতে। পঞ্চমহলে বসে রানীরা হাওয়া খেতেন। অনুপ তালাবের জল এখন শ্যাওলা ধরা হলেও একসময় নিশ্চই স্বচ্ছ ছিল। এর মাঝখানে এক বেশ বড় বসার জায়গা। জানা যায় ওখানে তানসেন গাইতেন। অনুপ তালাবের জল ছাড়া এখানে আর কোন জলের অস্তিত্ব নেই। এমনকি কোনও ফোয়ারা জাতিয় কিছু দেখলাম না। বোঝাযায় এখানে জলের উৎস হিসাবে বৃষ্টির উপরই নির্ভর করতে হত।
আকবর চিরকালই ফতেহপুর সিক্রীকে রাজধানি হিসেবে পছন্দ করতেন। প্রথমদিকে তাই করাও হয়েছিল। কিনতু নানান প্রদেশের বিদ্রোহ সামাল দেওয়া ফতেপুর সিক্রী থেকে অসুবিধা ছিল। প্রধান বাধা ছিল যাতায়াত। তাই সেইসময় রাজধানি আগ্রাতে স্থানান্তরিত করা হয়। শেষ জীবনে আবার তিনি ফতেপুর সিক্রী ফিরে যান এবং সেখানেই তিনি মারা যান।
আমাদের গাড়ির ড্রাইভার তাড়া দিচ্ছিল। তাই আমরা বেরিয়ে এলাম। পিছনে পড়ে রইল ইতিহাসের এক বিশাল অধ্যায়। অটো করে গাড়ীর কাছে পৌছলাম। গাড়ীতে চেপে পিছন ফিরে একবার কেল্লার দিকে ফিরে তাকালাম। সম্রাট আকবরের স্নেহধন্যা এই কেল্লা একা পরে আছে বছরের পর বছর। না জানি আরও কত বছর পরে থাকবে এই সুবিশাল আকাশের নীচে নিসঙ্গ একাকী।

দিল্লী-আগ্রা তৃতীয়দিন 11/10/17 পঞ্চমপর্ব


সকালে ঘুম ভাঙ্গলো রাজার ডাকে। গাড়ি নাকি আটটায় চলে আসবে অতএব তাড়াতাড়ি ওঠো। দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দেখি মা বাবা হাসিমুখে ছাদের সিড়ি দিয়ে নামছে। বলা হয়নি আমাদের হোটেলে রুফটপ রেস্ট্রোরেন্ট ছিল। যেখান থেকে তাজ দেখা যেত। মা বাব সেখান থেকেই ফটো তুলে নামছিল
আজ আমাদের ফতেপুর সিক্রী যাবার কথা। রাজা গতকাল গাড়ী ঠিক করে রেখেছিল। আমরা ব্রেকফাস্ট করে বেড়িয়ে পড়লাম। তবে আমি কিছু খাইনি, আগেরদিন থেকে আমার মাইগ্রেনের পেইন শুরু হয়েছে, খেলে হিতে বিপরিত।
বেশীক্ষণ নয় দেড় ঘন্টা লাগলো। গাড়ী আমাদের একজায়গায় নামালো তার থেকে বেশী যাবার তার অনুমতি নাই। আমরা একটা গাইড ঠিক করে তার ঠিক করা অটোতে চেপে বসলাম। তিন মিনিটে অটো থামলো একটা ছোট টিলার নীচে। যেখান থেকে ঢালু রাস্তা উঠে গেছে টিলার ওপরে কেল্লা পর্য্যন্ত। আমরা হাঁটা শুরু করলাম। গাইডের খুব তাড়া। আমাদের তাড়া দিয়েই চলেছে। কিন্তু আমরা তার কথায় কর্ণপাত না করে গজেন্দ্র গমনে গিয়ে পৌছলাম কেল্লার সামনে। ওরে বাবা সামনে গিয়ে দেখি দোতলা সমান উচ্চতা ওঠার জন্য খাঁড়া, সিঁড়ি নয়, ঢালু রাস্তা। উঠে এলাম। সবাই এখানে জুতো খুলছে কারণ ভিতরে সেলিম চিস্তির সমাধি মন্দির। আমাদের গাইডের পরিচিত একজনের হাওয়ালে জুতো রেখে আমরা গাইডের পিছু নিলাম। আমরা যেখান দিয়ে ঢুকলাম সেটিও একটি বড় গেট তবে সেটি বুলন্দ দরয়াজা নয়। ভিতরে ঢুকে দেখলাম এক সুবিশাল প্রশস্ত জায়গার এক কোনে সেলিম চিস্তির সমাধি মন্দির, সাদা মার্বেলে ঝক ঝক করছে। আর রয়েছে একটি মসজিদ। পুরো এলাকাটা ঘিরে রয়েছে ছোট ছোট ঘরে। গাইড বলল ওগুলো আকবরের তৈরী মেয়েদের জন্য মাদ্রাসা। ওখানে বেশ অনেকগুলি কবর দেখলাম। সেগুলি সবই সেলিম চিস্তির পরিবার পরিজনদের। স্থানীয় পসারীরা নানারকম মার্বেল পাথরের পসরা নিয়ে বসেছিল। সবচেয়ে খারাপ লাগলো 'সেলিম চিস্তির সমাধিতে চাদর চরানো' একটা ব্যবসা এখানে। প্রথমে বলে নেবে চাদর চড়ালে অমুক-তমুক ভালো হবে। তারপর তার দাম হাঁকবে, আটহাজার, পাঁচহাজার, এক হাজার। গাইড আমাদের একটি দরজা দেখালো যেটা সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে। ওটি একটি সুরঙ্গের প্রবেশ পথ। ওটার সাথে সংযোগ আছে আগ্রা ও লাহোর ফোর্টের। ইতিহাস বলে আকবরের প্রথম স্ত্রী রুকাইয়া বেগম আনারকলিকে ওই পথ দিয়েই পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন। গাইড নানারকম স্থানিয় ঘটনার কথা বলতে বলতে পসারিদের পাশ কাটিয়ে কেল্লার বাইরের দিকে নিয়ে এল। দূরে লাইট হাউসের মত দেখতে একটা জিনিস দেখালো। ওটা আকবরের প্রিয় হাতি সমাধি। আমরা আকবরের টাঁকশালও দেখলাম। আমাদের বাঁ দিকের কতগুলো construction দেখিয়ে গাইড বলল ওটা যোধাবাঈ মহল। কেল্লা আর যোধাবাঈ মহলের যে ফারাক, সেটা এখন গাছপালায় ভর্তি হয়ে গেলেও ওটা কেল্লার মধ্যেই ছিল। কিন্তু এখন মনে হয় দুটোই আলাদা। কেল্লার গায়ে ছোটছোট খুপরি করা হয়েছিল সে সময়কার ডাকহরকরা পায়রাদের জন্য। গাইড এবার আমাদের নিয়ে এল বুলন্দ দরয়াজার সামনে। দরজার গায়ে ছোটবড় নানান সাইজের ঘোড়ার নাল লাগানো। জানলাম আকবরের সময় থেকে কারও ঘোড়া অসুস্থ হলে সেলিম চিস্তির সমাধিতে মানত করতো, ঘোড়া সুস্থ হয়ে গেলে তার নাল ঐ দরজায় লাগিয়ে দিত। এই দরজা দিয়ে সম্রাট আকবর ঢুকতেন আর সাধারনের জন্য অন্য দরজা, যেখান দিয়ে আমরা ঢুকলাম। সে নিয়ম আজও চলছে, শুধু সম্রাটই আর নেই । বাস্তব থেকে বেখবর বুলন্দ দরজা যেন এখনও তার সম্রাটের অপেক্ষায় রোজ দরজা খুলে চেয়ে থাকে পথের দিকে। কিন্তু তার সম্রাট তো আজ ইতিহাস!

Saturday, 10 February 2018

দিল্লী আগ্রা দ্বিতীয় দিন 10/10/17 চতুর্থ পর্ব



রোদ কমে আসছিল। সাথে সাথে আমাদের এনার্জিও। আগ্রা ফোর্টের ভিতরে পাথরের আড়ালে বেশ ছায়া। ঢোকার মুখে বেশ চওড়া আর বিশাল উঁচু এক করিডোরের মত। যেখান থেকে হাততালি দিয়ে আগন্তুকের আগমন বার্তা পাঠানো হত কেল্লার ভিতরে। আশ্চর্য্য 'কথা' প্রতিফলিত হয়না কিন্তু 'আওয়াজ' প্রতিফলিত হয়। জায়গাটা ঢালু তাই দোতলার সমান উচ্চতা উঠে এলাম কোনও কষ্ট না করেই। পরপর মহল গুলো পার হচ্ছি আর চোখের সামনে যেন ইতিহাসের একএকটা অধ্যায় খুলে যাচ্ছে। সম্রাটদের পছন্দের নির্মানই তাদের পরিচয়। আকবর পছন্দ করতেন লাল বালু পাথর, জাহাঙ্গীর পছন্দ করতেন সাদা কিন্তু মার্বেল হয়তো সহজলভ্য ছিলনা সেই সময়। তাই বেলে পাথরের ওপর চুনের পলেস্তারা। আর শাহজাহানের মহল, সে এক অপূর্ব সৃষ্টি। সাদা মার্বেলের ওপর দামী রঙীন পাথরের নকশা। দেওয়ানি আম, দেওয়ানি খাস - সে এক অসাধারণ সৃষ্টি। আমরা এসে দাঁড়ালাম সেই মহলের সামনে যেখানে শাহজাহান শেষ ক'বছর বন্দী ছিলেন। পরন্ত বিকেলের আলোয় মহল টাকে আরও বেশী বিষন্ন লাগছিল। দেওয়ানি খাসের সামনের বিশাল প্রাঙ্গণ থেকে দেখা যাচ্ছিল তাজমহলকে। মনেহচ্ছিল তাজমহলও তার একাকীত্ব, বিষন্নতা ছড়িয়ে দিচ্ছে গোটা আগ্রা শহরে। এখান থেকেই দেখা যাচ্ছিল সেই বিখ্যাত ছাতার মত ছাদওয়ালা অলিন্দ, যেখান থেকে সম্রাট চেয়ে থাকতেন তাজমহলের দিকে। এতখানি ঘুরে আমার মা সামান্য অসুস্থ বোধ করছিলেন। একটা জায়গা দেখে উনি একটু বসলেন।আর আমরা চারপাশে চোখ ঘোরালাম। ঝাঁকেঝাঁকে টিয়াপাখি এসে কলরব করছে, এ এক বিরাট লোভনিয় দৃশ্য আমাদের কাছে। ইট কাঠ পাথরের জঙ্গলে এই দৃশ্য অমূল্য।আমাদের ঠিক নীচে একতলায় সার দিয়ে অসংখ্য কামরা। যারা দেখছিলেন বলতে শুরু করলেন ওগুলো দোকান। কিন্তু ওই পুরো এলাকা ছিল আকবরের হারেম। ওপরের ঘরে থাকতেন রানীরা আর নীচের ছোট একরকম ওই কোয়াটারস্ এ থাকতো সব দাস-দাসি।দোতলায় যেখানে আমরা দাঁড়িয়েছিলাম তার পাশেই ছিল সম্রাটের বসার আসন, যেখানে বসে উনি হারেমের অভাব-অভিযোগ শুনতেন ও বিচার করতেন। ওখান থেকে আমরা সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম দেওয়ানি আম। সম্রাট যেখানে বসতেন সে জায়গাটি খুব সুন্দর। উপরে রানীদের বসার জন্য আড়াল বজায় রেখে জায়গা রয়েছে। আমরা সকলেই জানি আকবরের সময়কাল থেকেই রাজমহিষীরা শাসনকাজে  এক বিশেষ জায়গা আলোকিত করে এসেছেন। দেওয়ানি আমের সামনেই রয়েছে বাবরের আমলে তৈরী বিশাল 'বাওলী'। বাওলী আর কুয়োঁর মধ্যে পার্থক্যটা এখানে বলে রাখি। বাওলীতে সিঁড়ি থাকে, কুয়োয় থাকেনা। আমরা এখান থেকেই সবার পিছুপিছু বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। বেরিয়েই যাচ্ছিলাম, কিন্তু থমকে দাঁড়ালাম সামনে একটা ইংরেজ সমাধি দেখে। নাম লেখা john russel colvin।হ্যাঁ মনে পড়লো পরেছিলাম উনি মোগলদের পতনের পর আগ্রা ফোর্টের চার্জে ছিলেন। কলেরা হয়ে মারা যান। ওনার দেহ বাইরে আনা যায়নি বলে ভিতরেই সমাধিস্ত করার পরিকল্পনা করা এবং সে স্থানটি ঠিক হয় একদম দেওয়ানি আমের সামনে। এ নিয়ে অনেকের আপত্তি থাকলেও শোনা হয়নি। সত্যি বড্ড বেমানান এই সমাধিটি এখানে। আর একটা কথার উল্লেখ করাটা একান্ত জরুরি। গজনীর সুলতান মামুদ যে সোমনাথ মন্দির আক্রমণ করে লুঠ করেছিলেন তা আমরা সকলেই জানি। তার সমাধি মন্দিরের দরজা ছিল হুবহু সোমনাথ মন্দিরের চন্দন কাঠের দরজার ন্যয়। অনুমান করা হয়ওটি সোমনাথ মন্দিরেরই দরজা। ইংরেজরা সেটি উখরে তুলে নিয়ে আসে আর আগ্রা ফোর্টে সেটি রাখে। কিন্তু পরে জানা যায় ওটি স্থানীয় কারিগর দিয়ে তৈরী একটি দরজা। সে দরজা আজও বিদ্যমান ফোর্টে।

বিকেল ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে সন্ধ্যের দিকে। আমরাও ইতিহাসকে 'কাল'এর হাতে ছেড়ে বেড়িয়ে এলাম।

আগ্রা-দিল্ল পর্ব- 3


ই মেহতাব বাগে ঢোকার মুখে গাছের ছায়ায় ছোটখাট খান দুই দোকান ছিল। তারই পাশে বসে একটা ঊট উদাস মুখে জাবর কাটছিল। আমরা একটা দোকানে বসে জল খেয়ে আগ্রা ফোর্টের দিকে রওনা দিলাম।রাস্তার মাঝেই রাজা হঠাৎ বলে বসলো 'আজ সময় নেই, তাজমহল কাল দেখবো' শুনেই আমার মাথা হয়ে গেল গরম। আমার কোলকাতা থেকেই পরিকল্পনা ছিল প্রথম দিন আগ্রা ফোর্ট আর তাজমহল আর দ্বিতীয় দিন ফতেহপুর সিক্রী দেখবো। শুধু শুধু দুটো জায়গা দেখে সময় নষ্ট হল।এর জন্য রাজার সাথে বেশ খানিকটা তর্ক বিতর্কও হল। তারওপর আগ্রা ফোর্টের সামনে দিয়ে হুস্ করে বেরিয়ে গেল অটো পরশুর দিল্লী যাবার বাস বুক করতে। মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে গেল। যাওয়ার সাথে সাথেই বাস বুকিং হয়ে গেল। আমরা যখন আগ্রা ফোর্টের সামনে পৌছলাম তখন পৌনে চারটে। তাজমহলে সারে চারটায় টিকিট দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়।

যাইহোক আমরা টিকিট কেটে ঢুকলাম। মা তো ভীষণ ভাবে ইমোশনাল হয়ে পরলো। ফ্লাশব্যাকে মা আকবরের আমলে চলে গেল। .....

যদিও বর্তমান দুর্গটির অধিকাংশই মোঘল আমলে নির্মিত হলেও সেখানে ১১ শতকে নির্মিত একটি প্রাচীন দুর্গের অবস্থান ছিল। ১৪৭৫ সালে আগ্রা ফোর্ট ছিল রাজা বাদল সিং এর অধীনে ইটের তৈরী একটি সামরিক দুর্গ। যার নাম ছিল বাদলগড়। ইতিহাসে ১০৮০ সালে সর্বপ্রথম এর উল্লেখ পাওয়া যায়। এ সময়ে গজনীর সামরিক বাহিনী এই দুর্গ দখল করে।সুলতান সিকান্দার লোদি (১৪৮৮-১৫১৭) দিল্লী থেকে তার রাজধানী আগ্রায় স্থানান্তর করেন। এরপর থেকে আগ্রা দ্বিতীয় রাজধানীর  স্থান পেয়েছিল এবং সুলতানি আমলে আগ্রা থেকেই রাজকীয় কর্মকান্ড পরিচালিত হত। তার পুত্র সিকান্দার লোদি ১৫১৭ সালে পানিপথের যুদ্ধে সম্রাট আকবারের নিকট পরাজিত ও নিহত হবার পূর্ব পর্য়ন্ত এখানে অবস্থান করেন। সিকান্দার লোদি এই কেল্লার বেশ কিছু ইমারত ও ইদারা নির্মাণ করেছিলেন।

১৫২৬ সালে দিল্লী জয়ের পর সম্রাট বাবর আগ্রা দুর্গে অবস্থান করেন। তিনি এখানে একটি বাউলি (সিঁড়ি যুক্ত ইদারা) নির্মাণ করেন। ১৫৩০ সালে এই দুর্গেসম্রাট হুমায়ুনের রাজ্যাভিষেক হয়। ১৫৪০ সালে হুমায়ুন বিলগ্রামে শের শাহরে কাছে পরাজিত হন। ১৫৫৫ সাল পর্য়ন্ত এই দুর্গ শের শাহের দখলে থাকে। এরপর হুমায়ন আগ্রা দুর্গ পুনরুদ্ধার করেন।
১৫৫৬ সালে আদিল শাহ শূরীর সেনাপতি হিমু আগ্রা ফোর্ট পুনরায় দখল করে এবং আগ্রার পলায়নরত গভর্ণরের পশ্চাতধাবন করেন। এসময়ে তুঘলকাবাদের সমরাঙ্গণে মোগল বাহিনীর সাথে তার যুদ্ধ হয়। যা তুঘলাকাবাদের যুদ্ধ নামে পরিচিত।

১৫৫৮ সালে সম্রাট আকবর আগ্রায় রাজধানী স্থানান্তর করেন। ঐতিহাসিক আবুল ফজল সেই সময়ের দুর্গকে বাদালগড় হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। সম্রাট আকবর রাজস্থানের আরাউলি থেকে সংগৃহীত বেলেপাথর দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ দুর্গটির সংস্কার সাধন করেন। দুর্গের ভিতরের অংশে ইটের গাঁথুনি আর বাইরের অংশে আছে বেলেপাথরের আস্তরন। প্রায় ৪ হাজার কর্মী ৮ বছর প্রতিদিন পরিশ্রম করে ১৫৭৩ সালে আগ্রা দুর্গের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করে।

সম্রাট আকবরের পৌত্র সম্রাট শাহজাহানের আমলে আগ্রা দুর্গ তার বর্তমান রূপ লাভ করে। শাহাজাহান লাল বেলেপাথরের নির্মিত ইামারতের চেয়ে শ্বেত পাথর দ্বারা নির্মিত ভবন অধিকতর পছন্দ করতেন।

১৮ শতকের প্রথম দিকে মারাঠা সম্রাট দুর্গটি দখল করেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে মারাঠা ও তাদের শত্রুরা আগ্রা দুর্গের নিয়ন্ত্রন গ্রহণ করে। ১৭৬১ সালেআহমেদ শাহ আবদালি পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধেমারাঠাদের পরাজিত করলে পরবর্তী এক দশক মারাঠারা এই দুর্গ দখলের কোন চেষ্টা করতে পারেনি।

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে এই দুর্গে দেশীয় সিপাহী ও ইংরেজ সৈন্যদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়

দিল্লী আগ্রা ২য় দিন পর্ব ২



নেমেই রোদ্দুরে মাথা ঘুরে যাবার যোগাড়। কিন্তু মনে মনে ফুটছি কতক্ষণে দর্শন হবে। আমাদের হোটেল বুক করা ছিল। ঠিক তাজমহলের পশ্চিম গেটের সামনে। রাজা ফোন করে হোটেলে যাবার পথ জিগ্গেস করে নিল। দু-তিনজন অটো ড্রাইভার আমাদের ছেঁকে ধরেছিল। তার মধ্যে অপেক্ষাকৃত বয়স্ক এক অটো ড্রাইভারের সাথে রফা হল। আমরা পোটলাপাটলী নিয়ে চেপে বসলাম। রাজা চলতেচলতেই অটোওয়ালার সাথে কথা বলে ঠিক করে নিল। খুব কমে কয়েকটা স্পট দেখাবে। আমরা হুরমুর করে হোটেলে ঢুকলাম, ঘর দেখলাম ,ফ্রেস হলাম ,বেড়িয়ে পরলাম। প্রতিটা মিনিট যেন আমাদের কাছে প্ল্যাটিনামের থেকেও দামি ছিল। প্রথমেই আমরা গেলাম একটা রেস্ট্রোরেন্টে। মেনুকার্ডটা হাতে নিয়ে অনুভব করলাম, সত্যি জব্বর ক্ষিদে পেয়েছে।সাথে জল পিপাসা।

খাওয়া শেষ করে প্রয়োজন মত জল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, 'বিবি কা মকবরা'র উদ্দ্যেশে। এর আবার অনেক নাম! স্থানিয় লোক বলে 'মিনি তাজ' আবার কেউ বলে 'মোতিবাগ'। সে যে নামেই ডাক, গোলাপ তো গোলাপই থাকে,এ-ও সেরকমই। এটি তৈরী করেছিলেন নুরজাহান, তার মা বাবার সমাধি হিসাবে। পরে তার পরিবারের সকলে এখানেই সমাধিস্ত হন। সত্যি মিনি তাজমহলই বটে কি অসাধারণ মার্বেল পাথরের জালির কাজ, ভাষায় বর্ননা করা যায়না। সমাধি, তাই জুতো খুলতে হবে। কিন্তু সানপাথর যেন তপ্ত তাওয়া। কার্পেট পাতা ছিল দৌড়ে গিয়ে তাতেই পা রেখে স্বস্তি।সমাধি  মন্দিরের দেওয়াল ছিল খুবই সাধারণ, অনারম্বর। কিন্তু ছাদে মোগোলিয়ানা সুস্পষ্ট। এই সমাধিই নাকি তাজমহলের প্রেরণা। চারিদিকে সুন্দর ফুলের বাগান। আমরা বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে।

আমাদের পরবর্তি গন্তব্য ছিল 'মেহতাব বাগ'। এই জায়গাটা ঠিক তাজমহলের উল্টোদিক, যমুনার অন্যপারে। তাজমহলের বেসমেন্টে যে 22টা ঘর রয়েছে সেগুলো এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়।শাহ্জাহান নিজের জন্য একটি কালো তাজমহল বানাবেন, যেটা আর পরবর্তী কালে বানানো হয়নি, সেটি এখানেই বানাবেন বলে মনস্থ করেছিলেন।জায়গাটা এমন কিছু আহামরি নয়। বাগান তৈরী হচ্ছে। তবে এখানে দাঁড়িয়ে তাজমহলের বিশালত্ব টের পাওয়া যায়।
এখানে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল সত্যিই কি শাহজান এখানে দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকতেন তাঁর অমোঘ সৃষ্টির দিকে। না আমি কোনও তর্ক বিতর্কে যেতে চাইনা যে তাজ কে বানিয়েছিলেন। আমি শুধু এর সৌন্দর্য্যের বিশালত্ব উপভোগ করি।

Friday, 9 February 2018

মীরজাফর




খুব আশ্চর্য্য হয়েছিলাম মুর্শিদাবাদে, যখন দেখলাম মীরজাফরকে ওখানকার লোক সিরাজের সমান সন্মান দিচ্ছে। একজনগাইড তো রিতীমত গর্জে উঠলেন,—“ওনাকে খারাপ বলবেন না। নবাব সীরাজৌদ্দলার বদলে যদি উনি নবাব হতেন তাহলে বাংলার এই অবস্থা  হতো না, ইংরেজ বাংলা নিতেই পারতোনা”। বলে কি লোকটা মীরজাফর খারাপ ছিলনা! মুর্শিদাবাদের ইতিহাস পরা শুরু করলাম।

আলিবর্দী খাঁ সিরাজকে অত্যন্ত আদর দীয়ে এক প্রকার বাঁদরই তৈরী করেছিলেন এবং শাষক হতে গেলে একজন মানুষের মধ্যে যে গুনগুলি থাকা দরকার তার সবকটি সিরাজের মধ্যে ছিল অনুপস্থিত। আলিবর্দী খাঁ সিরাজকে তাঁর লাকী চার্ম মনে করতেন তাই সিরাজকে দুধে-ভাতে রাখতেন। ফলে সিরাজের রাজ্য,শাষক,শাসন,কুটনিতী — এসব সম্বন্ধে কোনও ধারনাই তৈরী  হয়নি। অন্যদিকে মীরজাফরও আলিবর্দীর আত্মীয় ছিলেন। অত্যন্ত কমবয়স থেকেই তিনি শাসন সংক্রান্ত ব্যাপারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন,কুটনীতি বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। আলিবর্দী খাঁ যখন মারাঠা দস্যুদের নিয়ে নাকানিচোবানি খাচ্ছেন সেই সময় কিনতু মীরজাফর তিন মারাঠা দস্যু অর্থ্যাৎ বর্গী নেতাকে হত্যা করে পিছু হটতে বাধ্য করেন। সেই সময় সিরাজ কিন্তু ছিলেন বিলাসব্যসনে মত্ত।
যদি বংশ পরিচয় এবং রাজকিয় রক্ত নবাবী সিংহাসনের দাবীদার হয় তাহলেও সিরাজ পিছিয়ে ছিলেন। মীরজাফর ছিলেন ঈসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মহম্মদের নাতি। মীরজাফরের পিতা হুসেন নাজাফি ছিলেন মক্কায় হজরত মহম্মদের সমাধির কেয়ারটেকার। সম্রাট ঔরঙ্গজেব যখন মক্কা সরিফ যান তখন হুসেন নাজাফির সাথে আলাপ হয়। সম্রাট হুসেনের অগাধ জ্ঞান দেখে অভিভুত হয়ে তাকে দিল্লী নিয়ে আসেন এবং দেশের সর্বচ্চ আদালতের মুখ্য বিচারক পদে বহাল করেন। হুসেন নাজাফি সম্রাট শাহজাহানের বড় পুত্র তথা ঔরঙ্গজেবের বড় ভাই দারা শিখোর কন্যাকে বিবাহ করেন এবং তাদের সন্তান হলেন মীরজাফর । মীরজাফর আবার আলিবর্দী খাঁর ভাগ্নীকে বিবাহ করেন

যাইহোক সিরাজের চরিত্রে দৃঢ়তার খুবই অভাব ছিল। সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পেতেন। কুটনিতীজ্ঞ একেবারেই ছিলেন না। উনি  ওনার রাজসভায় হিন্দুদের প্রাধান্য দিয়ে ফেলায় ওনার নিজের সম্প্রদায়ের মানুষরা বিদ্বেষভাবাপন্ন হয়ে পড়ল। আর সেই সুযোগে জগৎশেঠ, উমিচাঁদের মত সার্থপর লোকেরা বাংলা লুটেপুটে খেতে লাগল। শুধু মীরজাফর নন অনেক অভিজ্ঞজনই তখন মনে করছিলেন বাংলাকে বাঁচানোর জন্য সিরাজের পতন অবশ্যম্ভাবী।

সিরাজের প্রতি মীরজাফরের কোনও ব্যক্তিগত আক্রোশ ছিলনা। সিরাজ ধরা পরার পর যখন মীরজাফরের পুত্র মীরমিরাণ তাঁকে প্রাণদন্ড দেবার জন্য দরবারে প্রস্তাব উথ্থাপন করেন। মীরজাফর কোনও উত্তর দেননি। পরে রাতেয় অন্ধকারে মীরজাফর বিশ্রাম নিতে চলে যাবার পর মীরমিরানের নির্দেশে মহম্মদি বেগ সিরাজকে হত্যা করেন এবং পরেরদিন সকালে সিরাজের দেহটুকরো গুলি হাতির পিঠে চেপে সারা মুর্শিদাবাদ ছড়ায়। খবর পেয়ে সিরাজের মা আমিনা বেগম সেই টুকরো একত্র করে খোসবাগে সমাধিস্থ করেন।
মীরান তার সিংহাসনে বসার পথ পরিস্কার করার জন্য সিরাজের ১১ বছরের ভাই মিরমেহেদী এবং আরএক ভাইপো মুরাদ্দৌল্লাকেও হত্যা করে।

‘নেমকহারাম ’ এই তকমাটাইংরেজদেরই দেওয়া কারন ইংরেজ জানতো মীরজাফর মনে মনে চাননি।  শুধুমাত্র  চাপের মুখে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। নেমকহারাম যে ছিলেন না তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ইংরেজরা তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। বিশ্বাসঘাতককে বাঁচিয়ে রাখা ইংরেজের স্বভাব বিরুদ্ধ।

Thursday, 18 January 2018

দদিল্লী আগ্রা পর্ব ১

দদিল্লী আগ্রা
পর্ব ১

হঠাৎ করে ঠিক একদিনের মধ্যে ঠিক হল আগ্রা যাব। এর আগে আমি আর রাজা আগ্রা গিয়েছি, তাজও দেখেছি, কিন্তু আগ্রা ফোর্ট বা ফতেহপুর সিক্রি দেখা হয় নি। সেই দেখা না হবার অবশ্য একটা কারণও ছিল! আসলে তখন আমরা দিল্লী গিয়েছিলাম সেই ফাঁকে আগ্রা দেখা। ঐভাবে আগ্রা দেখা হয় না, যেটা হয় সেটা একটা পিকনিক বলাই ভাল। প্রতিটি শিল্পের সৌন্দর্য্য উপভোগ করাটাও একটা বিশেষ বিষয় বটে।

যারা জানেন না তাদের জন্য বলি 1978 সালে  খুব ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। সেই সময় যমুনার জল ঢুকেছিল তাজমহলে। তাতে অবশ্য তাজের কোনও ক্ষতি হয়নি, তবে ক্ষতি হয়েছিল অনেক পর্যটকের যারা সেই সময় তাজ দেখবেন বলে মনস্থ করেছিলেন। তার মধ্যে আমার মা-বাবা অন্যতম।

এবারে তাই মা বাবাও আমাদের সঙ্গী।

যাবার দিন অর্থাৎ 9 তারিখ    সকাল থেকে নিম্নচাপের দাপাদাপি। বাবা তাদের পরিচিত লোকের গাড়ী ঠিক করেছিল। সে গাড়ী করে আমরা ন'টা নাগাদ পৌঁছালাম শিয়ালদা। নেমেই বিরক্তিতে আমার মেজাজ গেল খিঁচরে কারণ কোনও বসার জায়গা নেই আর এদিকে ট্রেন লেট। লেট মানে ডাউন গাড়ী এলে সেই গাড়ীতে যাব, এবং সে ডাউনগড়ীই লেট। রাজা খুঁজে পেতে একটা জায়গা তো বার করলো, কিন্তু শুনলাম গাড়ী ছাড়বে রাত একটায়।ডাউন গাড়ী ঢুকলো সাড়ে তিনটেয় আর ছাড়লো 10 তারিখ ভোর সাড়ে চারটায়। আমরা কেউ আর কারও সাথে কথা না বলে বেডরোল নিয়ে পটাপট শুয়ে পরলাম। মাবাবার সিট পরেছিল অন্য কম্পার্টমেন্টে। গাড়ীতে ওঠার আগে অনেক জল্পনা করেও শেষ অবদি আর চেঞ্জ করা হয়নি। বাবুই ঘুম থেকে উঠে ওখানেই চলে গিয়েছিল। রাজা একবার এখানে একবার ওখানে দৌড়ে গেল।

ট্রেন লেট হতে হতে সাড়ে পনেরো ঘনটা হল। যেখানে আগ্রা পৌছানোর কথা 10তারিখ সন্ধ্যে সাতটায়, সেটা পৌছালো 11তারিখ সকাল 10টায়। স্টেশনের কাছাকাছি আসতেই তাজমহল আর আগ্রা ফোর্ট দেখে আমরা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। অবশেষে নামলাম আগ্রা।